পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 8&S জামিন দিয়া খালাসের চেষ্টা এবং উকিল নিয়োগ সম্বন্ধে গোরা যে-সকল আপত্তি করিয়াছিল বিনয় তাহা সমস্তই বলিল— শুনিয়া হারানবাবু অসহিষ্ণু হইয়া কহিলেন, “এ-সমস্ত বাড়াবাড়ি ।” হারানবাবুর প্রতি ললিতার মনের ভাব যাই থােক, সে এপর্যন্ত র্তাহাকে মান্য করিয়া আসিয়াছে, কখনো তঁহার সঙ্গে তর্কে যোগ দেয় নাই- আজ সে তীব্রভাবে মাথা নাড়িয়া বলিয়া উঠিল, “কিছুমাত্র বাড়াবাড়ি নয়— গীেরবাবু যা করেছেন সে ঠিক করেছেন— ম্যাজিষ্ট্রেট আমাদের জব্দ করবে। আর আমরা নিজেরা নিজেকে রক্ষা করব ! তাদের মোটা মাইনে জোগাবার জন্যে ট্যাক্স জোগাতে হবে, আবার তাদের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে উকিল-কী গট থেকে দিতে হবে !! এমন বিচার পাওয়ার চেয়ে জেলে যাওয়া ভালো ।” ললিতাকে হারানবাবু এতটুকু দেখিয়াছেন— তাহার যে একটা মতামত আছে সে কথা তিনি কোনোদিন কল্পনাও করেন নাই। সেই ললিতার মুখের তীব্র ভাষা শুনিয়া আশ্চর্য হইয়া গেলেন ; তাহাকে ভৎসনার স্বরে কহিলেন, “তুমি এ সব কথার কী বােঝা ? যারা গোটাকতক বই মুখস্ত করে পাস করে সবে কলেজ থেকে বেরিয়ে এসেছে, যাদের কোনো ধর্ম নেই, ধারণা নেই, তাদের মুখ থেকে দায়িত্বহীন উন্মত্ত প্ৰলাপ শুনে তোমাদের মাথা ঘুরে যায় ।” এই বলিয়া গতকল্য সন্ধ্যার সময় গোরার সহিত ম্যাজিষ্ট্রেটের সাক্ষাৎ-বিবরণ এবং সে সম্বন্ধে র্তাহার নিজের সঙ্গে ম্যাজিষ্ট্রেটের আলাপের কথা বিবৃত করিলেন। চর-ঘোষপুরের ব্যাপার বিনয়ের জানা ছিল না। শুনিয়া সে শঙ্কিত হইয়া উঠিল ; বুঝিল, ম্যাজিষ্ট্রেট গোরাকে সহজে ক্ষমা করিবে না। হারান যে উদ্দেশ্যে এই গল্পটা বলিলেন তাহা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইয়া গেল। তিনি যে গোরার সহিত র্তাহার দেখা হওয়া সম্বন্ধে এতক্ষণ পর্যন্ত একেবারে নীরব ছিলেন তাহার ভিতরকার ক্ষুদ্রতা সুচরিতাকে আঘাত করিল এবং হারানবাবুর প্রত্যেক কথার মধ্যে গোরার প্রতি যে-একটা ব্যক্তিগত ঈর্ষা প্ৰকাশ পাইল তাঁহাতে গোরার এই বিপদের দিনে তাহার প্রতি উপস্থিত প্ৰত্যেকেরই একটা অশ্রদ্ধা জন্মাইয়া দিল। সুচরিতা এতক্ষণ চুপ করিয়া ছিল, কী একটা বলিবার জন্য তাহার আবেগ উপস্থিত হইল, কিন্তু সেটা সংবরণ করিয়া সে বই খুলিয়া কম্পিত হন্তে পাতা উলটাইতে লাগিল। ব্যাপারে গৌরমোহনবাবুর মহত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছে।” RS সকাল-সকাল শেষ করিয়া ফেলিতে চেষ্টা করিলেন । করিলেন। তিনি গতিক দেখিয়া বুঝিয়েছিলেন যে, অপরাধ স্বীকার করাই এ স্থলে ভালো চাল। ছেলেরা দুরন্ত হইয়াই থাকে, তাহারা অর্বাচীন নির্বোিধ ইত্যাদি বলিয়া তাঁহাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিলেন। ম্যাজিষ্ট্রেট ছাত্ৰাদিগকে জেলে লইয়া গিয়া বয়স ও অপরাধের তারতম্য অনুসারে পাঁচ হইতে পঁচিশ বেতের আদেশ করিয়া দিলেন। গোরার উকিল কেহ ছিল না। সে নিজের মামলা নিজে চালাইবার উপলক্ষে পুলিসের অত্যাচার সম্বন্ধে কিছু বলিবার চেষ্টা করিতেই ম্যাজিষ্ট্রেট তাঁহাকে তীব্র তিরস্কার করিয়া তাহার মুখ বন্ধ করিয়া দিলেন ও পুলিসের কর্মে বাধা দেওয়া অপরাধে তাহাকে এক মাস সশ্রম কারাদণ্ড দিলেন এবং এইরূপ লঘুদণ্ডকে বিশেষ দয়া বলিয়া কীর্তন করিলেন। সুধীর ও বিনয় আদালতে উপস্থিত ছিল। বিনয় গোরার মুখের দিকে চাহিতে পারিল না। তাহার যেন নিশ্বাস বন্ধ হইবার উপক্রম হইল, সে তাড়াতাড়ি আদালত-ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল । সুধীর তাহাকে ডাকবাংলায় ফিরিয়া গিয়া স্নানাহারের জন্য অনুরোধ করিল— সে শুনিল না, মাঠের রাস্তা দিয়া চলিতে চলিতে গাছের তলায় বসিয়া পড়িল । সুধীরকে কহিল, “তুমি বাংলায় ফিরে যাও, vol\S