পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ò R রবীন্দ্র-রচনাবলী কিছুক্ষণ পরে আমি যাব।” সুধীর চলিয়া গেল। এমন করিয়া যে কতক্ষণ কাটিয়া গেল তাহা সে জানিতে পারিল না। সূর্য মাথার উপর হইতে পশ্চিমের দিকে যখন হেলিয়াছে তখন একটা গাড়ি ঠিক তাহার সম্মুখে আসিয়া থামিল। বিনয় মুখ তুলিয়া দেখিল, সুধীর ও সুচরিতা গাড়ি হইতে নামিয়া তাহার কাছে আসিতেছে। বিনয় তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাড়াইল । সুচরিতা কাছে আসিয়া স্নেহাৰ্দ্ধস্বরে কহিল, “বিনয়বাবু, আসুন।” বিনয়ের হঠাৎ চৈতন্য হইল যে, এই দৃশ্যে রাস্তার লোকে কৌতুক অনুভব করিতেছে। সে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠিয়া পড়িল। সমস্ত পথ কেহ কিছুই কথা কহিতে পারিল না। ডাকবাংলায় পৌঁছিয়া বিনয় দেখিল সেখানে একটা লড়াই চলিতেছে। ললিতা বাকিয়া বসিয়াছে, সে কোনোমতেই আজ ম্যাজিষ্ট্রেটের নিমন্ত্রণে যোগ দিবে না। বরদাসুন্দরী বিষম সংকটে পড়িয়া গিয়াছেন। হারানবাবু ললিতার মতো বালিকার এই অসংগত বিদ্রোহে ক্ৰোধে অস্থির হইয়া উঠিয়াছেন। তিনি বার বার বলিতেছেন। আজকালকার ছেলেমেয়েদের এ কিরূপ বিকার ঘটিয়াছে— তাহারা ডিসিপ্লিন মানিতে চাহে না ! কেবল যে-সে লোকের সংসর্গে যাহা-তােহা আলোচনা করিয়াই এইরূপ ঘটিতেছে। বিনয় আসিতেই ললিতা কহিল, “বিনয়বাবু, আমাকে মাপ করুন। আমি আপনার কাছে ভারি অপরাধ করেছি; আপনি তখন যা বলেছিলেন। আমি কিছুই বুঝতে পারি নি ; আমরা বাইরের অবস্থা কিছুই জানি নে বলেই এত ভুল বুঝি। পানুবাবু বলেন ভারতবর্ষে ম্যাজিষ্ট্রেটের এই শাসন বিধাতার বিধান- তা যদি হয় তবে এই শাসনকে সমস্ত কায়মনোবাক্যে অভিশাপ দেবার ইচ্ছা জাগিয়ে দেওয়াও সেই বিধাতারই বিধান ।” হারানবাবু ক্রুদ্ধ হইয়া বলিতে লাগিলেন, “ললিতা, তুমি—” ললিতা হারানবাবুর দিক হইতে ফিরিয়া দাড়াইয়া কহিল, “চুপ করুন। আপনাকে আমি কিছু বলছি নে। বিনয়বাবু, আপনি কারও অনুরোধ রাখবেন না। আজ কোনোমতেই অভিনয় হতেই পারে না।” বরদাসুন্দরী তাড়াতাড়ি ললিতার কথা চাপা দিয়া কহিলেন, “ললিতা, তুই তো আচ্ছা মেয়ে দেখছি। বিনয়বাবুকে আজ স্নান করতে,খেতে দিবি নে ? বেলা দেড়টা বেজে গেছে তা জানিস ? দেখ দেখি ওঁর মুখ শুকিয়ে কী রকম চেহারা হয়ে গেছে।” বিনয় কহিল, “এখানে আমরা সেই ম্যাজিষ্ট্রেটের অতিথি- এ বাড়িতে আমি স্নানাহার করতে পারব না ।” বরদাসুন্দরী বিনয়কে বিস্তর মিনতি করিয়া বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন। মেয়েরা সকলেই চুপ করিয়া আছে দেখিয়া তিনি রাগিয়া বলিলেন, “তোদের সব হল কী ? সুচি, তুমি বিনয়বাবুকে একটু বুঝিয়ে বলো-না। আমরা কথা দিয়েছি- লোকজন সব ডাকা হয়েছে, আজকের দিনটা কোনোমতে কাটিয়ে যেতে হবে- নইলে ওরা কী মনে করবে বলো দেখি ! আর যে ওদের সামনে মুখ দেখাতে পারব | |” সুচরিতা চুপ করিয়া মুখ নিচু করিয়া বসিয়া রহিল। b. বিনয় অদূরে নদীতে স্টীমারে চলিয়া গেল। এই স্টীমার আজ ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই যাত্রী লইয়া কলিকাতায় রওনা হইবে- আগামী কাল আটটা আন্দাজ সময়ে সেখানে পৌঁছিবে । হারানবাবু উত্তেজিত হইয়া উঠিয়া বিনয় ও গোরাকে নিন্দা করিতে আরম্ভ করিলেন। সুচরিতা তাড়াতাড়ি চৌকি হইতে উঠিয়া পাশের ঘরে প্রবেশ করিয়া বেগে দ্বার ভেজাইয়া দিল। একটু পরেই ললিতা দ্বার ঠেলিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। দেখিল, সুচরিতা দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া বিছানার উপর পড়িয়া আছে। ললিতা ভিতর হইতে দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিয়া ধীরে ধীরে সুচরিতার পাশে বসিয়া তাহার মাথায় চুলের মধ্যে আঙুল বুলাইয়া দিতে লাগিল। অনেকক্ষণ পরে সুচরিতা যখন শান্ত হইল তখন জোর করিয়া তাহার মুখ হইতে বাহুর আবরণ মুক্ত করিয়া তাহার মুখের কাছে মুখ লইয়া গিয়া কানে কানে বলিতে