পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 রবীন্দ্র-রচনাবলী ললিত কহিল, “আমি কলকাতায় যাব- আমি কিছুতেই থাকতে পারলুম না।” বিনয় জিজ্ঞাসা করিল, “ওঁরা সকলে ?” ললিতা কহিল, “এখন পর্যন্ত কেউ জানেন না। আমি চিঠি রেখে এসেছি— পড়লেই জানতে পারবেন ।” স্থিত ঐ দুঃসাহসিকতায় বিল গুৰিত হয় গেল। সকালে সহিত বলতে আরম্ভ করে। ললিতা তাড়াতাড়ি বাধা দিয়া কহিল, “জাহাজ ছেড়ে দিয়েছে, এখন আর "কিন্তু নিয়ে কী হবে। মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছি বলেই যে সমস্তই চুপ করে সহ্য করতে হবে সে আমি বুঝি নে। আমাদের পক্ষেও ন্যায়-অন্যায় সম্ভব-অসম্ভব আছে | আজকের নিমন্ত্রণে গিয়ে অভিনয় করার চেয়ে আত্মহত্যা করা আমার পক্ষে সহজ ।” বিনয় বুঝিল যা হইবার তা হইয়া গেছে, এখন এ কাজের ভালোমন্দ বিচার করিয়া মনকে পীড়িত করিয়া তোলায় কোনো ফল নাই | কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া ললিত কহিল, “দেখুন, আপনার বন্ধু গৌরমোহনবাবুর প্রতি আমি মনে মনে বড়ো অবিচার করেছিলুম। জানি নে, প্রথম থেকেই কেন তাকে দেখে, তার কথা শুনে, আমার মনটা তার বিরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল । তিনি বড়ো বেশি জোর দিয়ে কথা কইতেন, আর আপনার সকলেই তাতে যেন সায় দিয়ে যেতেন— তাই দেখে আমার একটা রাগ হতে থাকত । আমার স্বভাবই ঐ— আমি যদি দেখি কেউ কথায় বা ব্যবহারে জোর প্রকাশ করছে, সে আমি একেবারেই সইতে পারি নে। কিন্তু গৌরমোহনবাবুর জোর কেবল পরের উপরে নয়, সে তিনি নিজের উপরেও খাটান— এ সত্যিকার জোর- এরকম মানুষ আমি দেখি নি।” এমনি করিয়া ললিতা বকিয়া যাইতে লাগিল। কেবল যে গােরা সম্বন্ধে সে অনুতাপ বােধ করিতেছিল বলিয়াই এ-সকল কথা বলিতেছিল তাহা নহে। আসলে, ঝোকের মাথায় যে কাজটা করিয়া ফেলিয়াছে তাহার সংকোচ মনের ভিতর হইতে কেবলই মাথা তুলিবার উপক্ৰম করিতেছিল, কাজটা হয়তো ভালো হয় নাই এই দ্বিধা জোর করিবার লক্ষণ দেখা যাইতেছিল, বিনয়ের সম্মুখে স্টীমারে এইরূপ একলা বসিয়া থাকা যে এতবড়ো কুষ্ঠার বিষয় তাহা সে পূর্বে মনেও করিতে পারে নাই, কিন্তু লজ্জা প্ৰকাশ হইলেই জিনিসটা অত্যন্ত লজ্জার বিষয় হইয়া উঠিবে এইজন্য সে প্ৰাণপণে বকিয়া যাইতে লাগিল। বিনয়ের মুখে ভালো করিয়া কথা জোগাইতেছিল না। এক দিকে গোরার দুঃখ ও অপমান, অন্য দিকে সে যে এখানে ম্যাজিষ্ট্রেটের বাড়ি আমোদ করিতে আসিয়াছিল। তাহার লজ্জা, তাহার উপরে ললিতার সম্বন্ধে তাহার এই অকস্মাৎ অবস্থাসংকট, সমস্ত একত্র মিশ্রিত হইয়া বিনয়কে বাক্যহীন করিয়া দিয়াছিল । পূর্বে হইলে ললিতার এই দুঃসাহসিকতায় বিনয়ের মনে তিরস্কারের ভাব উদয় হইত— আজ তাহা কোনোমতেই হইল না । এমন-কি, তাহার মনে যে বিস্ময়ের উদয় হইয়াছিল তাহার সঙ্গে শ্রদ্ধা মিশ্রিত ছিল- ইহাতে আরো একটি আনন্দ এই ছিল, তাহাদের সমস্ত দলের মধ্যে গোরার অপমানের সামান্য প্রতিকারচেষ্টা কেবল বিনয় এবং ললিতাই করিয়াছে। এজন্য বিনয়কে বিশেষ কিছু দুঃখ পাইতে হইবে না, কিন্তু ললিতাকে নিজের কর্মফলে অনেক দিন ধরিয়া রিস্তর পীড়া ভোগ করিতে হইবে । অথচ এই ললিতাকে বিনয় বরাবর গোরার বিরুদ্ধ বলিয়াই জানিত ।। যতই ভাবিতে লাগিল ততই ললিতার এই পরিণামবিচারহীন সাহসে এবং অন্যায়ের প্রতি একান্ত ঘূণায় তাহার প্রতি বিনয়ের ভক্তি জন্মিতে লাগিল । কেমন করিয়া কী বলিয়া যে সে এই ভক্তি প্ৰকাশ করিবে তাহা ভাবিয়া পাইল না । বিনয় বার বার ভাবিতে লাগিল, ললিতা যে তাঁহাকে এত পরমুখাপেক্ষী সাহসহীন বলিয়া ঘূণা প্রকাশ করিয়াছে সে ঘূণা যথার্থ। সে তো সমস্ত আত্মীয়বন্ধুর নিন্দ প্রশংসা সবলে উপেক্ষা করিয়া এমন করিয়া কোনো বিষয়েই সাহসিক আচরণের দ্বারা নিজের মত প্ৰকাশ করিতে পারিত না । সে যে অনেক সময়েই গোরাকে কষ্ট দিবার ভয়ে অথবা পাছে গোরা তাহাকে দুর্বল মনে করে এই আশঙ্কায় নিজের স্বভাবের