পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 88s ললিত হাত টানিয়া লইয়া কহিল, “তোর যে আসুক এখন বিরক্ত করিস নে। এখন বাবার কাছে যাচ্ছি।” সতীশ কহিল, “বাবা বেরিয়ে গেছেন, তার আসতে দেরি হবে ।” শুনিয়া বিনয় এবং ললিতা উভয়েই ক্ষণকালের জন্য একটা আরাম বোধ করিল। ললিতা জিজ্ঞাসা করিল, “কে এসেছে ?” সতীশ কহিল, “বলব না! আচ্ছা, বিনয়বাবু, বলুন দেখি কে এসেছে ? আপনি ককখনােই বলতে পারবেন না। ককখনো না, ককখনো না ।” : বিনয় অত্যন্ত অসম্ভব ও অসংগত নাম করিতে লাগিল- কখনো বলিল নবাব সিরাজউদ্দৌলা, কখনো বলিল রাজা নবকৃষ্ণ, একবার নন্দকুমারেরও নাম করিল। এরূপ অতিথিসমাগম যে একেবারেই অসম্ভব সতীশ তাঁহারই অকাট্য কারণ দেখাইয়া উচ্চৈঃস্বরে প্রতিবাদ করিল। বিনয় হার মানিয়া নম্রস্বরে কহিল, “তা বটে, সিরাজউদ্দৌলার যে এ বাড়িতে আসার কতকগুলো গুরুতর অসুবিধা আছে সে কথা আমি এপর্যন্ত চিন্তা করে দেখি নি। যা হােক, তোমার দিদি তো আগে তদন্ত করে আসুন, তার পরে যদি প্রয়োজন হয় আমাকে ডাক দিলেই আমি যাব।” সতীশ কহিল, “না, আপনারা দুজনেই আসুন ।” ললিতা জিজ্ঞাসা করিল, “কোন ঘরে যেতে হবে ?” সতীশ কহিল, “তেতালার ঘরে ।” তেতালার ছাদের কোণে একটি ছােটাে ঘর আছে, তাহার দক্ষিণের দিকে রৌদ্র-বৃষ্টি-নিবারণের জন্য একটি ঢালু টালির ছাদ । সতীশের অনুবতী দুইজনে সেখানে গিয়া দেখিল ছোটাে একটি আসন পাতিয়া সেই ছাদের নীচে একজন প্রৌঢ় স্ত্রীলোক চােখে চশমা দিয়া কৃত্তিবাসের রামায়ণ পড়িতেছেন । তাহার চশমার এক দিককার ভাঙা দণ্ডে দড়ি বাধা, সেই দড়ি তাহার কানে জড়ানো । বয়স পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি হইবে । মাথার সামনের দিকে চুল বিরল হইয়া আসিয়াছে, কিন্তু গীেরবর্ণ মুখ পরিপক্ক ফলটির মতো এখনাে প্রায় নিটােল রহিয়াছে; দুই ভুর মাঝে একটি উলকির দাগ- গায়ে অলংকার নাই, বিধবার বেশ। প্রথমে ললিতার দিকে চােখ পড়িতেই তাড়াতাড়ি চশমা খুলিয়া বই ফেলিয়া রাখিয়া, বিশেষ একটা ঔৎসুক্যের সহিত তাহার মুখের দিকে চাহিলেন ; পরীক্ষণেই তাহার পশ্চাতে বিনয়কে দেখিয়া দ্রুত উঠিয়া দাড়াইয়া মাথায় কাপড় টানিয়া দিলেন এবং ঘরের মধ্যে প্রবেশ কেন ? এই আমাদের ললিতাদিদি, আর ইনি বিনয়বাবু। বড়দিদি কাল আসবেন।” বিনয়বাবুর এই অতিসংক্ষিপ্ত পরিচয়ই যথেষ্ট হইল ; ইতিপূর্বেই বিনয়বাবু সম্বন্ধে আলোচনা যে প্রচুর পরিমাণে হইয়া গিয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই। পৃথিবীতে সতীশের যে-কয়টি বলিবার বিষয় জমিয়াছে কোনো উপলক্ষ পাইলেই তাহা সতীশ বলে এবং হাতে রাখিয়া বলে না । মাসিম বলিতে যে এখানে কাহাকে বুঝায় তাহা না বুঝিতে পারিয়া ললিতা অবাক হইয়া দাড়াইয়া রহিল। বিনয় এই প্রৌঢ়া রমণীকে প্ৰণাম করিয়া তাহার পায়ের ধূলা লইতেই ললিতা তাহার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিল। মাসিমা তাড়াতাড়ি ঘর হইতে একটি মাদুর বাহির করিয়া পাতিয়া দিলেন এবং কহিলেন, “বাবা বোসো, মা বোসো ।” বিনয় ও ললিতা বসিলে পর তিনি তাহার আসনে বসিলেন এবং সতীশ তাহার গা ঘেষিয়া বসিল । তিনি সতীশকে ডান হাত দিয়া নিবিড়ভাবে বেষ্টন করিয়া ধরিয়া কহিলেন, “আমাকে তোমরা জান না, আমি সতীশের মাসি হই— সতীশের মা আমার আপনি দিদি ছিলেন।” এইটুকু পরিচয়ের মধ্যে বেশি কিছু কথা ছিল না। কিন্তু মাসিমার মুখে ও কণ্ঠস্বরে এমন একটি কী ছিল যাহাতে র্তাহার জীবনের সুগভীর শোকের অশ্রুমার্জিত পবিত্র একটি আভাস প্রকাশিত হইয়া পড়িল । “আমি সতীশের মাসি হই বলিয়া তিনি যখন সতীশকে বুকের কাছে চাপিয়া ধরিলেন তখন এই রমণীর জীবনের ইতিহাস কিছুই না জানিয়াও বিনয়ের মন করুণায় ব্যথিত হইয়া উঠিল। বিনয়