পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

GO NR রবীন্দ্র-রচনাবলী করি বা মনে মনে জপ করিতেছিলেন। বিনয় তাড়াতাড়ি তাহার পায়ের কাছে লুটাইয়া পড়িয়া কহিল, "; זצ" আনন্দময়ী তাহার অবলুষ্ঠিত মাথায় দুই হাত বুলাইয়া কহিলেন, “বিনয় ।” মা’র মতো এমন কণ্ঠস্বর কার আছে! সেই কণ্ঠস্বরেই বিনয়ের সমস্ত শরীরে যেন করুণার স্পর্শ বহিয়া গেল। সে অশ্রুজল কষ্টে রোধ করিয়া মুক্তকণ্ঠে কহিল, “মা, আমার দেরি হয়ে গেছে!” আনন্দময়ী কহিলেন, “সব কথা শুনেছি বিনয় ।” বিনয় চকিত হইয়া কহিল, “সব কথাই শুনেছ!” গোরা হাজত হইতেই তাহাকে পত্র লিখিয়া উকিলবাবুর হাত দিয়া পঠাইয়াছিল। সে যে জেলে যাইবে সে কথা সে নিশ্চয় অনুমান করিয়াছিল। পত্রের শেষে ছিল— 'কারাবাসে তোমার গোরার লেশমাত্র ক্ষতি করিতে পরিবে না। কিন্তু তুমি একটুও কষ্ট পাইলে চলিবে না । তোমার দুঃখই আমার দণ্ড, আমাকে আর-কোনো দণ্ড ম্যাজিষ্ট্রেটের দিবার সাধ্য নাই। একা তোমার ছেলের কথা ভাবিয়াে নৃ মা, আরো অনেক মায়ের ছেলে বিনা দােষে জেল খাটিয়া থাকে, একবার তাহাদের কষ্টের সমান ক্ষেত্রে দাড়াইবার ইচ্ছা হইয়াছে ; এই ইচ্ছা! এবার যদি পূর্ণ হয় তুমি আমার জন্য ক্ষোভ করিয়ো না । “মা, তোমার মনে আছে কি না জানি না, সেবার দুর্ভিক্ষের বছরে আমার রাস্তার ধারের ঘরের টেবিলে আমার টাকার থলিটা রাখিয়া আমি পাঁচ মিনিটের জন্য অন্য ঘরে গিয়াছিলাম । ফিরিয়া আসিয়া দেখি, থলিটা চুরি গিয়াছে। থলিতে আমার স্কলারশিপের জমানো পচাশি টাকা ছিল ; মনে সংকল্প করিয়াছিলাম আরো কিছু টাকা জমিলে তোমার পা ধোবার জলের জন্য একটি রুপার ঘটি তৈরি করাইয়া দিব । টাকা চুরি গেলে পর যখন চােরের প্রতি ব্যর্থ রাগে জ্বলিয়া মরিতেছিলাম তখন ঈশ্বর আমার মনে হঠাৎ একটা সুবুদ্ধি দিলেন, আমি মনে মনে কহিলাম, যে ব্যক্তি আমার টাকা লইয়াছে আজ দুর্ভিক্ষের দিনে তাহাকেই আমি সে টাকা দান করিলাম । যেমনি বলা অমনি আমার মনের নিম্বফল ক্ষোভ সমস্ত শান্ত হইয়া গেল । আজ আমার মনকে আমি তেমনি করিয়া বলাইয়াছি যে, আমি ইচ্ছা করিয়াই জেলে যাইতেছি । আমার মনে কোনো কষ্ট নাই, কাহারও উপরে রাগ নাই | জেলে আমি আতিথ্য লইতে চলিলাম । সেখানে আহারবিহারের কষ্ট আছে- কিন্তু এবারে ভ্রমণের সময় নানা ঘরে আতিথ্য লইয়াছি ; সে-সকল জায়গাতে তো নিজের অভ্যাস ও আবশ্যক। —মতো আরাম পাই নাই | ইচ্ছা! করিয়া যাহা গ্ৰহণ করি সে কষ্ট তো কষ্টই নয় ; জেলের আশ্রয় আজ আমি ইচ্ছা করিয়াই গ্ৰহণ করিব ; যতদিন আমি জেলে থাকিব একদিনও কেহ আমাকে জোর করিয়া সেখানে রাখিবে না ইহা তুমি নিশ্চয় জানিয়ো । ‘পৃথিবীতে যখন আমরা ঘরে বসিয়া অনায়াসেই আহারবিহার করিতেছিলাম, বাহিরের আকাশ এবং আলোকে অবাধ সঞ্চরণের অধিকার যে কত বড়ো প্ৰকাণ্ড অধিকার তাহা অভ্যাসবশত অনুভবমাত্র করিতে পারিতেছিলাম না— সেই মুহুর্তেই পৃথিবীর বহুতর মানুষই দোষে এবং বিনা দোষে ঈশ্বরদত্ত বিশ্বের অধিকার হইতে বঞ্চিত হইয়া যে বন্ধন এবং অপমান ভােগ করিতেছিল আজ পর্যন্ত তাহাদের কথা ভাবি নাই, তাহাদের সঙ্গে কোনাে সম্বন্ধই রাখি নাই— এবার আমি তাঁহাদের সমান দাগে দাগি হইয়া বাহির হইতে চাই ; পৃথিবীর অধিকাংশ বঁাচাইয়া চলিতে চাই না । “মা, এবার পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় হইয়া আমার অনেক শিক্ষা হইয়াছে। ঈশ্বর জানেন, পৃথিবীতে যাহারা বিচারের ভার লইয়াছে তাহারাই অধিকাংশ কৃপাপাত্র। যাহারা দণ্ড পায় না, দণ্ড দেয়, তাহাদেরই পাপের শাস্তি জেলের কয়েদিরা ভোগ করিতেছে ; অপরাধ গড়িয়া