পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা Ꮚ OᏔᎧ আছে, সম্মানে আছে, তাহাদের পাপের ক্ষয় কবে কোথায় কেমন করিয়া হইবে তাহা জানি না । আমি সেই আরাম ও সম্মানকে ধিক্কার দিয়া মানুষের কলঙ্কের দাগ বুকে চিহ্নিত করিয়া বাহির । হইব ; মা, তুমি আমাকে আশীর্বাদ করো, তুমি চােখের জল ফেলিয়াে না। ভৃগুপদাঘাতের চিহ্ন : শ্ৰীকৃষ্ণ চিরদিন বক্ষে ধারণ করিয়াছেন ; জগতে ঔদ্ধত্য যেখানে যত অন্যায় আঘাত করিতেছে ভগবানের বুকের সেই চিহ্নকেই গাঢ়তর করিতেছে। সেই চিহ্ন যদি তার অলংকার হয় তবে আমার ভাবনা কী, তোমারই বা দুঃখ কিসের ? এই চিঠি পাইয়া আনন্দময়ী মহিমকে গোরার কাছে পাঠাইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন । মহিম বলিলেন, আপিস আছে, সাহেব কোনোমতেই ছুটি দিবে না। বলিয়া গোরার অবিবেচনা ও ঔদ্ধত্য লইয়া তাহাকে যথেষ্ট গালি দিতে লাগিলেন ; কহিলেন, উহার সম্পর্কে কোনদিন আমার সুদ্ধ চাকরিটি যাইবে। আনন্দময়ী কৃষ্ণদয়ালকে এ সম্বন্ধে কোনাে কথা বলা অনাবশ্যক বােধ করিলেন। গােরা সম্বন্ধে স্বামীর প্রতি র্তাহার একটি মর্মান্তিক অভিমান ছিল ; তিনি জানিতেন, কৃষ্ণদয়াল গোরাকে হৃদয়ের মধ্যে পুত্রের স্থান দেন নাই— এমন-কি, গোরা সম্বন্ধে তীহার অন্তঃকরণে একটা বিরুদ্ধ ভাব ছিল। গোরা আনন্দময়ীর দাম্পত্যসম্বন্ধকে বিন্ধ্যাচলের মতো বিভক্ত করিয়া মাঝখানে দাড়াইয়া ছিল । তাহার এক পারে অতি সতর্ক শুদ্ধাচার লইয়া কৃষ্ণদয়াল একা, এবং তাহার অন্য পারে তাহার স্লেচ্ছ গোরাকে লইয়া একাকিনী আনন্দময়ী। গোরার জীবনের ইতিহাস পৃথিবীতে যে দুজন জানে তাঁহাদের মাঝখানে যাতায়াতের পথ যেন বন্ধ হইয়া গিয়াছে। এই সকল কারণে সংসারে গোরার প্রতি আনন্দময়ীর স্নেহ নিতান্তই তাহার একলার ধন ছিল । এই পরিবারে গোরার অনধিকার অবস্থানকে তিনি সব দিক দিয়া যত হালকা করিয়া রাখা সম্ভব তাহার চেষ্টা করিতেন । পাছে কেহ বলে “তোমার গোরা হইতে এই ঘটিল, তোমার গোরার জন্য এই কথা শুনিতে হইল, অথবা “তোমার গোরা আমাদের এই লোকসান করিয়া দিল, আনন্দময়ীর এই এক নিয়ত ভাবনা ছিল । গোরার সমস্ত দায় যে তাঁহারই। আবার তাহার গোরাও তো সামান্য দুরন্ত গোরা নয়। যেখানে সে থাকে। সেখানে তাহার অস্তিত্ব গোপন করিয়া রাখা তো সহজ ব্যাপার নহে। এই তাহার কোলের খেপা গোরাকে এই বিরুদ্ধ পরিবারের মাঝখানে এতদিন দিনরাত্রি তিনি সামলাইয়া এতবড়ো করিয়া তুলিয়াছেন- অনেক কথা শুনিয়াছেন যাহার কোনো জবাব দেন নাই, অনেক দুঃখ সহিয়াছেন যাহার অংশ আর কাহাকেও দিতে পারেন নাই । আনন্দময়ী চুপ করিয়া জানালার কাছে বসিয়া রহিলেন— দেখিলেন কৃষ্ণদয়াল প্ৰাতঃস্নান সারিয়া ললাটে বাহুতে বক্ষে গঙ্গামৃত্তিকার ছাপ লাগাইয়া মন্ত্র উচ্চারণ করিতে করিতে বাড়িতে প্রবেশ করিলেন, তাহার কাছে আনন্দময়ী যাইতে পারিলেন না। নিষেধ, নিষেধ, নিষেধ, সর্বত্রই নিষেধ ! অবশেষে নিশ্বাস ফেলিয়া আনন্দময়ী উঠিয়া মহিমের ঘরে গেলেন । মহিম তখন মেঝের উপর বসিয়া খবরের কাগজ পড়িতেছিলেন এবং তঁহার ভূত্য স্নানের পূর্বে র্তাহার গায়ে তেল মালিশ করিয়া দিতেছিল। আনন্দময়ী তীহাকে কহিলেন, “মহিম, তুমি আমার সঙ্গে একজন লোক দাও, আমি যাই গোরার কী হল দেখে আসি। সে জেলে যাবে বলে মনস্থির করে বসে আছে ; যদি তার জেল হয় আমি কি তার আগে তাকে একবার দেখে আসতে পারব না ?” মহিমের বাহিরের ব্যবহার যেমনি হউক, গোরার প্রতি র্তাহার এক প্রকারের মেহছিল। তিনি মুখে গর্জন করিয়া গেলেন যে, “যাক লক্ষ্মীছাড়া জেলেই যাক— এতদিন যায়নি এই আশ্চর্য।” এই বলিয়া পরীক্ষণেই তাঁহাদের অনুগত পরান ঘোষালকে ডাকিয়া তাহার হাতে উকিল-খরচার কিছু টাকা দিয়া তখনই তাহাকে রওনা করিয়া দিলেন এবং আপিসে গিয়া সাহেবের কাছে ছুটি যদি পান এবং বউ যদি সম্মতি দেন তবে নিজেও সেখানে যাইবেন স্থির করিলেন। আনন্দময়ীও জানিতেন, মহিম গোরার জন্য কিছু না করিয়া কখনো থাকিতে পরিবেন না । মহিম যথাসম্ভব ব্যবস্থা করিয়াছেন শুনিয়া তিনি নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিলেন। তিনি স্পষ্টই জানিতেন,