পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(፩ Obr রবীন্দ্র-রচনাবলী হারানবাবু মাঝে মাঝে সতীশের স্বভাব সংশোধনের চেষ্টা করা ছাড়া তাহার সঙ্গে আর কোনোপ্রকার সংস্রব রাখেন নাই । পরেশবাবু স্নান করিয়া আসিবামাত্র সতীশ তাহার দুই দিদিকে টানিয়া লইয়া গেল। হারান কহিলেন, “সুচরিতার সম্বন্ধে সেই- যে প্রস্তাবটা ছিল, আমি আর বিলম্ব করতে চাই নে। আমার ইচ্ছা, আসছে। রবিবারেই সে কাজটা হয়ে যায়।” পরেশবাবু কহিলেন, “আমার তাতে তো কোনাে আপত্তি নেই, সুচরিতার মত হলেই হল।” হারান। তার তো মত পূর্বেই নেওয়া হয়েছে। পরেশবাবু। আচ্ছা, তবে সেই কথাই রইল । \) ( সেদিন ললিতার নিকট হইতে আসিয়া বিনয়ের মনের মধ্যে কাটার মতো একটা সংশয় কেবলই ফিরিয়া ফিরিয়া বিধিতে লাগিল । সে ভাবিতে লাগিল, “পরেশবাবুর বাড়িতে আমার যাওয়াটা কে? ইচ্ছা করে বা না করে তাহা ঠিক না জানিয়া আমি গায়ে পড়িয়া সেখানে যাতায়াত করিতেছি । হয়তো সমাজের নিয়ম আমি জানি না ; এ বাড়িতে আমার অধিকার যে কোন সীমা পর্যন্ত তাহা আমার কিছুই জানা নাই। আমি হয়তো মূঢ়ের মতো এমন জায়গায় প্রবেশ করিতেছি যেখানে আত্মীয় ছাড়া কাহারও গতিবিধি নিষেধ ।” এই কথা ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ তাহার মনে হইল, ললিত হয়তো আজ তাহার মুখের ভাবে এমন একটা-কিছু দেখিতে পাইয়াছে যাহাতে সে অপমান বােধ করিয়াছে। ললিতার প্রতি বিনয়ের মনে ভাব যে কী এতদিন তাহা বিনয়ের কাছে স্পষ্ট ছিল না। আজ আর তাহা গোপন নাই। হৃদয়ে ভিতরকার এই নূতন অভিব্যক্তি লইয়া যে কী করিতে হইবে তাহা সে কিছুই ভাবিয়া পাইল না। বাহিরের সঙ্গে ইহার যোগ কী, সংসারের সঙ্গে ইহার সম্বন্ধ কী, ইহা কি ললিতার প্রতি অসম্মান, ইহ কি পরেশবাবুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, তাহা লইয়া সে সহস্রবার করিয়া তোলাপাড়া করিতে লাগিল ললিতার কাছে সে ধরা পড়িয়া গেছে এবং সেইজন্যই ললিতা তাহার প্রতি রাগ করিয়াছে, এই কথ কল্পনা করিয়া সে যেন মাটির সঙ্গে মিশিয়া যাইতে লাগিল । পরেশবাবুর বাড়ি যাওয়া বিনয়ের পক্ষে অসম্ভব হইল এবং নিজের বাসার শূন্যতাও যেন একটু ভারের মতো হইয়া তাহাকে চাপিতে লাগিল । পরদিন ভোরের বেলাই সে আনন্দময়ীর কাছে আসিয় উপস্থিত হইল। কহিল, “মা, কিছুদিন আমি তোমার এখানে থাকব ।” আনন্দময়ীকে গোরার বিচ্ছেদশোকে সাস্তুনা দিবার অভিপ্ৰায়ও বিনয়ের মনের মধ্যে ছিল । তাই বুঝিতে পারিয়া আনন্দময়ীর হৃদয় বিগলিত হইল। কোনাে কথা না বলিয়া তিনি সস্নেহে একবা বিনয়ের গায়ে হাত বুলাইয়া দিলেন। বিনয় তাহার খাওয়াদাওয়া সেবাশুশ্রুষা লইয়া বহুবিধ আবদার জুড়িয়া দিল। এখানে তাহা যথোচিত যত্ন হইতেছে না বলিয়া সে মাঝে মাঝে আনন্দময়ীর সঙ্গে মিথ্যা কলহ করিতে লাগিল সর্বদাই সে গোলমাল বকবকি করিয়া আনন্দময়ীকে ও নিজেকে ভুলইয়া রাখিতে চেষ্টা করিল সন্ধ্যার সময় যখন মনকে বাধিয়া রাখা দুঃসাধ্য হইত, তখন বিনয় উৎপাত করিয়া আনন্দময়ীকে তঁহি সকল গৃহকর্ম হইতে ছিনাইয়া লইয়া ঘরের সম্মুখের বারান্দায় মাদুর পাতিয়া বসিত ; আনন্দময়ী তাহার ছেলেবেলার কথা, তাহার বাপের বাড়ির গল্প বলাইত ; যখন র্তাহার বিবাহ হয় নাই, যখন তি তাহার অধ্যাপক পিতামহের টােলের ছাত্রদের অত্যন্ত আদরের শিশু ছিলেন, এবং পিতৃহীনা বালিকা সকলে মিলিয়া সকল বিষয়েই প্রশ্রয় দিত বলিয়া তাহার বিধবা মাতার বিশেষ উদবেগের কা ছিলেন, সেই সকল দিনের কাহিনী । বিনয় বলিত, “মা, তুমি যে কোনোদিন আমাদের মা ছিলে না (