পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ο Σ. Ο রবীন্দ্র-রচনাবলী নিবেদন করিতে না পারিলে কথাটা কোনােমতেই নির্মল হইয়া উঠিত না— ইহা তাহার চিন্তার মধ্যে কালির দাগ দিতে থাকিত । রাত্রে আনন্দময়ী অনেকক্ষণ এই কথা লইয়া মনে মনে আলোচনা করিয়াছিলেন। গোরার জীবনের যে সমস্যা উত্তরোত্তর জটিল হইয়া উঠিতেছিল। পরেশবাবুর ঘরেই তাহার একটা মীমাংসা ঘটিতে পাৰে। এই কথা মনে করিয়া তিনি ভাবিতে লাগিলেন, যেমন করিয়া হউক, মেয়েদের সঙ্গে একবার দেখা করিতে হইবে । VV শশিমুখীর সঙ্গে বিনয়ের বিবাহ যেন একপ্রকার স্থির হইয়া গেছে। এইভাবে মহিম এবং তঁহার ঘরের লোকেরা চলিতেছিলেন । শশিমুখী তো বিনয়ের কাছেও আসিত না । শশিমুখীর মা'র সঙ্গে বিনয়ের পরিচয় ছিল না বলিলেই হয় । তিনি যে ঠিক লাজুক ছিলেন তাহা নহে, কিন্তু অস্বাভাবিক রকমের গোপনচারিণী ছিলেন। তাহার ঘরের দরজা প্রায়ই বন্ধ। স্বামী ছাড়া তাহার আর সমস্তই তালাচাবির | মধ্যে। স্বামীও যে যথেষ্ট খোলা পাইতেন তাহা নহে— স্ত্রীর শাসনে তাহার গতিবিধি অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট এবং তাহার সঞ্চরণক্ষেত্রের পরিধি নিতান্ত সংকীর্ণ ছিল । এইরূপ ঘের দিয়া লওয়ার স্বভাব-বশত শশিমুখীর মা লক্ষ্মমণির জগৎটি সম্পূর্ণ তাহার আয়ত্তের মধ্যে ছিল— সেখানে বাহিরের লোকের ভিতরে এবং ভিতরের লোকের বাহিরে যাওয়ার পথ অবারিত ছিল না | এমন-কি, গোরাও লক্ষ্মমণির মহলে তেমন করিয়া আমল পাইত না । এই রাজ্যের বিধিব্যবস্থার মধ্যে কোনো দ্বৈধ ছিল না । কারণ, এখানকার বিধানকর্তাও লক্ষ্মীমণি এবং নিম্ন-আদালত হইতে আপিল-আদালত পর্যন্ত সমস্তই লক্ষ্মীমণি— একজিকটিভ এবং জুডিশিয়ালে তো ভেদ ছিলই না, লেজিসলেটিভও তাহার সহিত লক্ষ্মীমণির এলাকার মধ্যে তাহার নিজের ইচ্ছা খাটাইবার কোনো পথ ছিল না । সামান্য বিষয়েও না। লক্ষ্মীমণি বিনয়কে আড়াল হইতে দেখিয়াছিলেন, পছন্দও করিয়াছিলেন । মহিম বিনয়ের বাল্যকাল হইতে গোরার বন্ধুরূপে তাহাকে এমন নিয়ত দেখিয়া আসিয়াছেন যে, অতিপরিচয়বশতই তিনি বিনয়কে নিজের কন্যার পাত্ৰ বলিয়া দেখিতেই পান নাই। লক্ষ্মীমণি যখন বিনয়ের প্রতি তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিলেন তখন সহধর্মিণীর বুদ্ধির প্রতি তাহার শ্রদ্ধা বাড়িয়া গেল। লক্ষ্মীমণি পাকা করিয়াই স্থির করিয়া দিলেন যে, বিনয়ের সঙ্গেই তাহার কন্যার বিবাহ হইবে। এই প্রস্তাবের একটা মস্ত সুবিধার কথা তিনি তাহার স্বামীর মনে মুদ্রিত করিয়া দিলেন যে, বিনয় তাহাদের কােছ হইতে কোনো পণ দাবি করিতে পরিবে না । 4. বিনয়কে বাড়িতে পাইয়াও দুই-এক দিন মহিম তাহাকে বিবাহের কথা বলিতে পারেন নাই | গোরার কারাবাস-সম্বন্ধে তাহার মন বিষন্ন ছিল বলিয়া তিনি নিরস্ত ছিলেন । আজ রবিবার ছিল। গৃহিণী মহিমের সাপ্তাহিক দিবানিদ্রাটি সম্পূর্ণ হইতে দিলেন না। বিনয় নূতন-প্রকাশিত বঙ্কিমের "বঙ্গদর্শন লইয়া আনন্দময়ীকে শুনাইতেছিল— পানের ডিবা হাতে লইয় সেইখানে আসিয়া মহিম তক্ত পোশের উপরে ধীরে ধীরে বসিলেন । প্রথমত বিনয়কে একটা পান দিয়া তিনি গোরার উদ্ধৃঙ্খল নিবুদ্ধিতা লইয়া বিরক্তি প্রকাশ করিলেন । তাহার পরে তাহার খালাস হইতে আর কয়দিন বাকি তাহা আলোচনা করিতে গিয়া অত্যন্ত অকস্মাৎ মনে পড়িয়া গেল যে, আত্মান মাসের প্রায় অর্ধেক হইয়া আসিয়াছে। কহিলেন, “বিনয়, তুমি যে বলেছিলে অভ্রান মাসে তোমাদের বংশে বিবাহ নিষেধ আছে, সেটা কোনো কাজের কথা নয়। একে তো পাজিপুঁথিতে নিষেধ ছাড়া কথাই নেই, তার উপরে যদি ঘরের শাস্ত্র বানাতে থাক তা হলে বংশরক্ষা হবে কী করে ?” বিনয়ের সংকট দেখিয়া আনন্দময়ী কহিলেন, “শশিমুখীকে এতটুকুবেলা থেকে বিনয় দেখে