পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা Ο Σ. Σ আসছে— ওকে বিয়ে করার কথা ওর মনে লাগছে না ; সেইজন্যেই অম্লান মাসের ছুতো করে বসে 5吸” মহিম কহিলেন, “সে কথা তো গোড়ায় বললেই হত ।” আনন্দময়ী কহিলেন, “নিজের মন বুঝতেও যে সময় লাগে | পাত্রের অভাব কী আছে মহিম | গোৱা ফিরে আসুক— সে তো অনেক ভালো ছেলেকে জানে— সে একটা ঠিক করে দিতে পারবে ।” মহিম মুখ অন্ধকার করিয়া কহিলেন, “হঁ।” খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, তাহার পরে কহিলেন, “ম, তুমি যদি বিনয়ের মন ভাঙিয়ে না দিতে তা হলে ও এ কাজে আপত্তি করত না।” বিনয় ব্যস্ত হইয়া কী একটা বলিতে যাইতেছিল, আনন্দময়ী বাধা দিয়া কহিলেন, “তা, সত্য কথা বলছি মহিম, আমি ওকে উৎসাহ দিতে পারি নি। বিনয় ছেলেমানুষ, ও হয়তো না বুঝে একটা কাজ করে বসতেও পারত, কিন্তু শেষকালে ভালো হত না ।” আনন্দময়ী বিনয়কে আড়ালে রাখিয়া নিজের পরেই মহিমের রাগের ধাক্কাটা গ্ৰহণ করিলেন । বিনয় তাহা বুঝিতে পারিয়া নিজের দুর্বলতায় লজ্জিত হইয়া উঠিল। সে নিজের অসম্মতি স্পষ্ট করিয়া প্রকাশ করিতে উদ্যত হইলে মহিম আর অপেক্ষা না করিয়া মনে মনে এই বলিতে বলিতে বাহির হইয়া গেলেন যে, বিমাতা কখনো আপন হয় না । মহিম যে এ কথা মনে করিতে পারেন এবং বিমাতা বলিয়া তিনি যে সংসারের বিচারক্ষেত্রে বরাবর ভাবিয়া চলা তাহার অভ্যাসই ছিল না। যেদিন তিনি গোরাকে কোলে তুলিয়া লইয়াছেন সেইদিন হইতেই লোকের আচার, লোকের বিচার হইতে র্তাহার প্রকৃতি একেবারে স্বতন্ত্র হইয়া গেছে। সেদিন হইতে তিনি এমন-সকল আচরণ করিয়া আসিয়াছেন যাহাতে লোকে তাহার নিন্দাই করে । তাহার জীবনের মর্মস্থানে যে একটি সত্যগোপন তাহাকে সর্বদা পীড়া দিতেছে লোকনিন্দায় তাহাকে সেই পীড়া হইতে কতকটা পরিমাণে মুক্তি দান করে। লোকে যখন তাহাকে খৃস্টান বলিত তিনি গোরাকে কোলে চাপিয়া ধরিয়া বলিতেন— ‘ভগবান জানেন খৃস্টান বলিলে আমার নিন্দা হয় না।’ এমনি করিয়া ক্রমে সকল বিষয়েই লোকের কথা হইতে নিজের ব্যবহারকে বিচ্ছিন্ন করিয়া লওয়া তাহার স্বভাবসিদ্ধ হইয়াছিল। এইজন্য মহিম তীহাকে মনে মনে বা প্রকাশ্যে বিমাতা বলিয়া লাঞ্ছিত করিলেও তিনি নিজের পথ হইতে বিচলিত হইতেন না । আনন্দময়ী কহিলেন, “বিনু, তুমি পরেশবাবুদের বাড়ি অনেক দিন যাও নি।” বিনয় কহিল, “অনেক দিন আর কই হল ?” আনন্দময়ী | স্টীমার থেকে আসার পরদিন থেকে তো একবারও যাও নি । সে তো বেশিদিন নহে। কিন্তু বিনয় জানিত, মাঝে পরেশবাবুর বাড়ি তাহার যাতায়াত এত বাড়িয়াছিল যে আনন্দময়ীর পক্ষেও তাহার দর্শন দুর্লভ হইয়া উঠিয়ছিল। সে হিসাবে পরেশবাবুর বাড়ি অনেক দিন যাওয়া হয় নাই এবং লোকের তাহা লক্ষ্য করিবার বিষয় হইয়াছে বটে। বিনয় নিজের ধুতির প্রান্ত হইতে একটা সূতা ছিড়িতে ছিড়িতে চুপ করিয়া রহিল। এমন সময় বেহারিা আসিয়া খবর দিল, “মাজি, কঁহাসে মায়ীলোক আয় ।” বিনয় তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাড়াইল । কে আসিল, কোথা হইতে আসিল, খবর লইতে লইতেই সুচরিতা ও ললিতা ঘরের মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিল। বিনয়ের ঘর ছাড়িয়া বাহিরে যাওয়া ঘটিল। নী ; সে স্তম্ভিত হইয়া দাড়াইয়া রহিল। দুজনে আনন্দময়ীর মায়ের ধূলা লইয়া প্ৰণাম করিল। ললিতা বিনয়কে বিশেষ লক্ষ্য করিল না ; আনন্দময়ীর দিকে চাহিয়া সে কহিল, “আমরা পরেশবাবুর বাড়ি থেকে আসছি।” আনন্দময়ী তাহাদিগকে আদর করিয়া বসাইয়া কহিলেন, “আমাকে সে পরিচয় দিতে হবে না । তীেমাদের দেখি নি, মা, কিন্তু তোমাদের আপনার ঘরের বলেই জানি।”