পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

( δ Ν. রবীন্দ্র-রচনাবলী দেখিতে দেখিতে কথা জমিয়া উঠিল। বিনয় চুপ করিয়া বসিয়া আছে দেখিয়া সুচরিতা তাহলে আলাপের মধ্যে টানিয়া লইবার চেষ্টা করিল ; মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি অনেক দিন আমাদের ওখানে যান নি যে ?” বিনয় ললিতার দিকে একবার দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া লইয়া কহিল, “ঘন ঘন বিরক্ত করলে পাছে আপনাদের স্নেহ হারাই, মনে এই ভয় হয় ।” সুচরিতা একটু হাসিয়া কহিল, “স্নেহও যে ঘন ঘন বিরক্তির অপেক্ষা রাখে, সে আপনি জানেন না বুঝি ?” আনন্দময়ী কহিলেন, “তা ও খুব জানে মা ! কী বলব তোমাদের— সমস্ত দিন ওর ফরমাশে আর আবদারে আমার যদি একটু অবসর থাকে ৷” এই বলিয়া স্নিগ্ধদৃষ্টি-দ্বারা বিনয়কে নিরীক্ষণ করিলেন। বিনয় কহিল, “ঈশ্বর তোমাকে ধৈৰ্য দিয়েছেন, আমাকে দিয়ে তারই পরীক্ষা করিয়ে নিচ্ছেন।" সুচরিতা ললিতাকে একটু ঠেলা দিয়া কহিল, “শুনছিস ভাই ললিতা, আমাদের পরীক্ষাটা বুঝি শেষ । হয়ে গেল ! পাস করতে পারি নি বুঝি ?” ললিতা এ কথায় কিছুমাত্র যোগ দিল না দেখিয়া আনন্দময়ী হাসিয়া কহিলেন, “এবার আমাদের বিনু নিজের ধৈর্যের পরীক্ষা করছেন। তোমাদের ও যে কী চক্ষে দেখেছে সে তো তোমরা জান না। সন্ধেবেলায় তোমাদের কথা ছাড়া কথা নেই। আর পরেশবাবুর কথা উঠলে ও তো একেবারে গলে शाश ।' আনন্দময়ী ললিতার মুখের দিকে চাহিলেন ; সে খুব জোর করিয়া চােখ তুলিয়া রাখিল বটে, কিন্তু বৃথা লাল হইয়া উঠিল। আনন্দময়ী কহিলেন, “তোমার বাবার জন্যে ও কত লোকের সঙ্গে ঝগড়া করেছে ! ওরা দলের লোকেরা তো ওকে ব্ৰাহ্ম বলে জাতে ঠেলবার জো করেছে। বিনু, অমন অস্থির হয়ে উঠলে চলবে না বাছা- সত্যি কথাই বলছি । এতে লজ্জা করবারও তো কোনো কারণ দেখি নে । কী বল মা ? এবার ললিতার মুখের দিকে চাহিতেই তাহার চোখ নামিয়া পড়িল । সুচরিতা কহিল, “বিনয়বাবু যে আমাদের আপনার লোক বলে জানেন সে আমরা খুব জানি- কিন্তু সে যে কেবল আমাদেরই গুণে তা নয়, সে ওর নিজের ক্ষমতা ।” আনন্দময়ী কহিলেন, “তা ঠিক বলতে পারি। নে মা ! ওকে তো এতটুকুবেলা থেকে দেখছি, এতদিন ওর বন্ধুর মধ্যে এক আমার গােরাই ছিল ; এমন-কি, আমি দেখেছি। ওদের নিজের দলের লোকের সঙ্গেও বিনয় মিলতে পারে না । কিন্তু তোমাদের সঙ্গে ওরা দুদিনের আলাপে এমন হয়েছে যে আমরাও ওর আর নাগাল পাই নে। ভেবেছিলুম এই নিয়ে তোমাদের সঙ্গে ঝগড়া করব, কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি। আমাকেও ওরই দলে ভিড়তে হবে । তোমরা সক্কলকেই হার মানাবে। ” এই বলিয়া আনন্দময়ী একবার ললিতার ও একবার সুচরিতার চিবুক স্পর্শ করিয়া অঙ্গুলিদ্বারা চুম্বন গ্রহণ করিলেন । সুচরিতা বিনয়ের দুরবস্থা লক্ষ্য করিয়া সদয়চিত্তে কহিল, “বিনয়বাবু, বাবা এসেছেন ; তিনি বাইরে কৃষ্ণদয়ালবাবুর সঙ্গে কথা কচ্ছেন।” শুনিয়া বিনয় তাড়াতাড়ি বাহিরে চলিয়া গেল। তখন গোরা ও বিনয়ের অসামান্য বন্ধুত্ব লইয় আনন্দময়ী আলোচনা করিতে লাগিলেন। শ্রোতা দুইজনে যে উদাসীন নহে তাহা বুঝিতে র্তাহার বর্ণ ছিল না। আনন্দময়ী জীবনে এই দুটি ছেলেকেই তাহার মাতৃস্নেহের পরিপূর্ণ অর্ঘ্য দিয়া পূজা করি। আসিয়াছেন, সংসারে ইহাদের চেয়ে বড়ে তাহার আর কেহ ছিল না। বালিকার পূজার শিবের মতো। ইহাদিগকে তিনি নিজের হাতেই গড়িয়াছেন বটে, কিন্তু ইহারাই তাহার সমস্ত আরাধনা গ্ৰহ করিয়াছে। র্তাহার মুখে তাহার এই দুটি ক্রোড়দেবতার কাহিনী স্নেহরসে এমন মধুর উজ্জ্বল হই । উঠিল যে সুচরিতা এবং ললিতা অতৃপ্তহৃদয়ে শুনিতে লাগিল। গোরা এবং বিনয়ের প্রতি তাহাৰি