পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা Q> ○ শ্ৰদ্ধার অভাব ছিল না, কিন্তু আনন্দময়ীর মতো এমন মায়ের এমন মেহের ভিতর দিয়া তাহাদের সঙ্গে যেন আর-একটু বিশেষ করিয়া, নূতন করিয়া পরিচয় হইল। আনন্দময়ীর সঙ্গে আজ জানাশুনা হইয়া ম্যাজিষ্ট্রেটের প্রতি ললিতার রাগ আরো যেন বাড়িয়া উঠিল। ললিতার মুখে উষ্ণবাক্য শুনিয়া আনন্দময়ী হাসিলেন । কহিলেন, “মা, গোরা আজ জেলখানায়, এ দুঃখ যে আমাকে কী রকম বেজেছে তা অন্তর্যামীই জানেন। কিন্তু সাহেবের উপর আমি রাগ করতে পারি নি। আমি তো গােরাকে জানি, সে যেটাকে ভালো বােঝে তার কাছে আইনকানুন কিছুই মানে না ; যদি না মানে তবে যারা বিচারকর্তা তারা তো জেলে পাঠাবেই- তাতে তাদের দোষ দিতে যাবে কেন ? গোরার কাজ গোরা করেছে- ওদের কর্তব্য ওরা করেছে- এতে , যাদের দুঃখ পাবার তারা দুঃখ পাবেই। আমার গোরার চিঠি যদি পড়ে দেখ, মা, তা হলে বুঝতে পারবে ও দুঃখকে ভয় করে নি, কারও উপর মিথ্যে রাগও করে নি- যাতে যা ফল হয় তা সমস্ত নিশ্চয় জেনেই কাজ করেছে।” এই বলিয়া গোরার সযতুরক্ষিত চিঠিখনি বাক্স হইতে বাহির করিয়া সুচরিতার হাতে দিলেন। কহিলেন, “মা, তুমি চেচিয়ে পড়ো, আমি আর-এক বার শুনি।” । গোরার সেই আশ্চর্য চিঠিখনি পড়া হইয়া গেলে পর তিনজনেই কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন । আনন্দময়ী তাহার চােখের প্রান্ত আঁচল দিয়া মুছিলেন। সে যে চােখের জল তাঁহাতে শুধুমাতৃহৃদয়ের বাথা নহে, তাহার সঙ্গে আনন্দ এবং গৌরব মিশিয়া ছিল । তাহার গোরা কি যে-সে গোরা ! ম্যাজিষ্ট্রেট তাহার কসুর মাপ করিয়া তাহাকে দয়া করিয়া ছাড়িয়া দিবেন, সে কি তেমনি গোরা ! সে যে অপরাধ সমস্ত স্বীকার করিয়া জেলের দুঃখ ইচ্ছা করিয়া নিজের কঁধে তুলিয়া লইয়াছে। তাহার সে দুঃখের জন্য কাহারও সহিত কোনো কলহ করিবার নাই | গোরা তাহা অকাতরে বহন করিতেছে এবং আনন্দময়ীও ইহা সহ্য করিতে পরিবেন। ললিতা আশ্চর্য হইয়া আনন্দময়ীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। ব্ৰহ্মপরিবারের সংস্কার ললিতার মনে খুব দৃঢ় ছিল ; যে মেয়েরা আধুনিক প্রথায় শিক্ষা পায় নাই এবং যাহাদিগকে সে হীিদুবাড়ির মেয়ে বলিয়া জানিত তাঁহাদের প্রতি ললিতার শ্রদ্ধা ছিল না। শিশুকালে বরদাসুন্দরী তাঁহাদের যে অপরাধের প্রতি লক্ষ করিয়া বলিতেন ‘হিন্দুবাড়ির মেয়েরাও এমন কাজ করে না’ সে অপরাধের জন্য ললিতা বরাবর একটু বিশেষ করিয়াই মাথা হেঁট করিয়াছে। আজ আনন্দময়ীর মুখের কয়টি কথা শুনিয়া তাহার অন্তঃকরণ বার বার করিয়া বিস্ময় অনুভব করিতেছে। যেমন বল তেমনি শান্তি, তেমনি আশ্চর্য সদবিবেচনা। অসংযত হৃদয়াবেগের জন্য ললিতা নিজেকে এই রমণীর কাছে খুবই খর্ব করিয়া অনুভব করিল। তাহার মনের ভিতরে আজ ভরি একটা ক্ষুব্ধতা ছিল, সেইজন্য সে বিনয়ের মুখের দিকে চায় নাই, তাহার সঙ্গে কথাও কয় নাই। কিন্তু আনন্দময়ীর স্নেহে করুণায় ও শাস্তিতে মণ্ডিত মুখখানির দিকে চাহিয়া তাহার বুকের ভিতরকার সমস্ত বিদ্রোহের তাপ যেন জুড়াইয়া গেল— চারি দিকের সকলের সঙ্গে তাহার সম্বন্ধ সহজ হইয়া আসিল । ললিতা আনন্দময়ীকে কহিল, “গীেরবাবু যে এত শক্তি কোথা থেকে পেয়েছে তা আপনাকে দেখে আজ বুঝতে পারলুম।” আনন্দময়ী কহিলেন, “ঠিক বোঝ নি। গোরা যদি আমার সাধারণ ছেলের মতো হত তা হলে আমি কোথা থেকে বল পেতুম ! তা হলে কি তার দুঃখ আমি এমন করে সহ্য করতে পারতুম!” । ললিতার মনটা আজ কেন যে এতটা বিকল হইয়া উঠিয়ছিল তাহার একটু ইতিহাস বলা আবশ্যক । 弱 এ কয়দিন প্রত্যহ সকালে বিছানা হইতে উঠিয়াই প্রথম কথা ললিতার মনে এই জাগিয়াছে যে, আজ বিনয়বাবু আসিবেন না। অথচ সমস্ত দিনই তাহার মন এক মুহূর্তের জন্যও বিনয়ের আগমন প্রতীক্ষা করিতে ছাড়ে নাই। ক্ষণে ক্ষণে সে কেবলই মনে করিয়াছে বিনয় হয়তো আসিয়াছে, হয়তো সে উপরে না আসিয়া নীচের ঘরে পরেশবাবুর সঙ্গে কথা কহিতেছে। এইজন্য দিনের মধ্যে কতবার মে অপসারণে এ ঘরে ও ঘরে ঘুরিয়াছে তাহার ঠিক নাই। অবশেষে দিন যখন অবসান হয়, রাত্রে যখন