পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা (2)○ অপমানে তাহার বিষম একটা রাগ হইতে লাগিল। বিনয়কে এখানে দেখিতে পাইবার আশাতেই আনন্দময়ীর বাড়ি আসিবার জন্য যে তাহার এতটা আগ্ৰহ জন্মিয়ছিল, এই কথাটা সে মনে মনে একেবারে অস্বীকার করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল এবং নিজের সেই জিদ বজায় রাখিবার জন্য না বিনয়ের দিকে তাকাইল, না তাহার নমস্কার ফিরাইয়া দিল, না তাহার সঙ্গে একটা কথা কহিল। বিনয় মনে করিল, ললিতার কাছে তাহার মনের গোপন কথাটা ধরা পড়িয়াছে বলিয়াই সে অবজ্ঞার দ্বারা তাহাকে এমন করিয়া প্রত্যাখ্যান করিতেছে। ললিতা যে তাহাকে ভালোবাসিতেও পারে, এ কথা অনুমান করিবার উপযুক্ত আত্মাভিমান বিনয়ের ছিল না। বিনয় আসিয়া সংকোচে দরজার কাছে দাড়াইয়া কহিল, “পরেশবাবু এখন বাড়ি যেতে চাচ্ছেন, এদের সকলকে খবর দিতে বললেন ।” - ললিত যাহাতে তাহাকে না দেখিতে পায় এমন করিয়াই বিনয় দাড়াইয়াছিল। আনন্দময়ী কহিলেন, “সে কি হয় ! কিছু মিষ্টিমুখ না করে বুঝি যেতে পারেন!! আর বেশি দেরি হবে না। তুমি এখানে একটু বোসো বিনয়, আমি একবার দেখে আসি । বাইরে দাঁড়িয়ে রইলে কেন, ঘরের মধ্যে এসে বোসে ।” বিনয় ললিতার দিকে আড় করিয়া কোনােমতে দূরে এক জায়গায় বসিল । যেন বিনয়ের প্রতি তাহার ব্যবহারের কোনাে বৈলক্ষণ্য হয় নাই এমনি সহজভাবে ললিত কহিল, “বিনয়বাবু, আপনার বন্ধু সতীশকে আপনি একেবারে ত্যাগ করেছেন কি না জািনবার জন্যে সে আজ সকালে আপনার বাড়ি গিয়েছিল যে ।” y হঠাৎ দৈববাণী হইলে মানুষ যেমন আশ্চর্য হইয়া যায় সেইরূপ বিস্ময়ে বিনয় চমকিয়া উঠিল । তাহার সেই চমকটা দেখা গেল বলিয়া সে অত্যন্ত লজ্জিত হইল। তাহার স্বভাবসিদ্ধ নৈপুণ্যের সঙ্গে কোনো জবাব করিতে পারিল না ; মুখ ও কর্ণমূল লাল করিয়া কহিল, “সতীশ গিয়েছিল নাকি ? আমি তো বাড়িতে ছিলুম না ।” ললিতার এই সামান্য একটা কথায় বিনয়ের মনে একটা অপরিমিত আনন্দ জন্মিল ; এক মুহুর্তে বিশ্বজগতের উপর হইতে একটা প্ৰকাণ্ড সংশয় যেন নিশ্বাসরোধকর দুঃস্বপ্নের মতো দূর হইয়া গেল । যেন এইটুকু ছাড়া পৃথিবীতে তাহার কাছে প্রার্থনীয় আর কিছু ছিল না। তাহার মন বলিতে লাগিল— 'বাঁচিলাম, বাচিলাম । ললিতা রাগ করে নাই, ললিতা তাহার প্রতি কোনো সন্দেহ করিতেছে না । দেখিতে দেখিতে সমস্ত বাধা কাটিয়া গেল । সুচরিতা হাসিয়া কহিল, “বিনয়বাবু, হঠাৎ আমাদের নখী দন্তী শৃঙ্গী অস্ত্ৰপাণি কিংবা ঐরকম একটা-কিছু বলে সন্দেহ করে বসেছেন ।” বিনয় কহিল, “পৃথিবীতে যারা মুখ ফুটে নালিশ করতে পারে না, চুপ করে থাকে, তারাই উলটে আসামী হয়। দিদি, তোমার মুখে এ কথা শোভা পায় না— তুমি নিজে কত দূরে চলে গিয়েছ এখন বিনয় আজ প্রথম সুচরিতাকে দিদি বলিল । সুচরিতার কানে তাহা মিষ্ট লাগিল, বিনয়ের প্রতি প্রথম পরিচয় হইতেই সুচরিতার যে একটি সৌহৃদ্য জন্মিয়ছিল এই দিদি সম্বোধন মাত্রেই তাহা যেন একটি স্নেহপূর্ণ বিশেষ আকার ধারণ করিল। পরেশবাবু তাহার মেয়েদের লইয়া যখন বিদায় লইয়া গেলেন তখন দিন প্রায় শেষ হইয়া গেছে। বিনয় আনন্দময়ীকে কহিল, “মা, আজ তোমাকে কোনাে কাজ করতে দেব না | চলে উপরের ঘরে ।” বিনয় তাহার চিত্তের উদবোলতা সংবরণ করিতে পারিতেছিল না। আনন্দময়ীকে উপরের ঘরে শহীয়া গিয়া মেঝের উপরে নিজের হাতে মাদুর পতিয়া তঁহাকে বসাইল। আনন্দময়ী বিনয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিনু, কী, তাের কথাটা কী ?” বিনয় কহিল, “আমার কোনো কথা নেই, তুমি কথা বলে ।”

  • মেয়েদিগকে আনন্দময়ীর কেমন লাগিল সেই কথা শুনিবার জন্যই বিনয়ের মন ছটফট কীরিতেছিল ।