পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

४४७ রবীন্দ্র-রচনাবলী আনন্দময়ী কহিলেন, “বেশ, এইজন্যে তুই বুঝি আমাকে ডেকে আনলি! আমি বলি, বুঝি কোনো কথা আছে।” বিনয় কহিল, “না ডেকে আনলে এমন সূর্যস্তটি তো দেখতে পেতে না।” সেদিন কলিকাতার ছাদগুলির উপরে অগ্রহায়ণের সূর্য মলিনভাবেই অস্ত যাইতেছিল— বর্ণচ্ছটার কোনো বৈচিত্ৰ্য ছিল না— আকাশের প্রান্তে ধূমলবর্ণের বাম্পের মধ্যে সোনার আভা অস্পষ্ট হইয়া জড়াইয়াছিল। কিন্তু এই স্নান সন্ধ্যার ধূসরতাও আজ বিনয়ের মনকে রাঙাইয়া তুলিয়াছে। তাহার মনে হইতে লাগিল, চারি দিক তাহাকে যেন নিবিড় করিয়া ঘিরিয়াছে, আকাশ তাহাকে যেন স্পর্শ করিতেছে। আনন্দময়ী কহিলেন, “মেয়ে দুটি বড়ো লক্ষ্মী।” বিনয় এই কথাটাকে থামিতে দিল না । নানা দিক দিয়া এই আলোচনাকে জাগ্ৰত করিয়া রাখিল । পরেশবাবুর মেয়েদের সম্বন্ধে কতদিনকার কত ছোটােখাটাে ঘটনার কথা উঠিয়া পড়িল— তাহার অনেকগুলিই অকিঞ্চিৎকর, কিন্তু সেই অগ্রহায়ণের স্নানায়মান নিভৃত সন্ধ্যায় নিরালা ঘরে বিনয়ের উৎসাহ এবং আনন্দময়ীর ঔৎসুক্য -দ্বারা এই সকল ক্ষুদ্র গৃহকোণের অখ্যাত ইতিহাসখণ্ড একটি গভীর মহিমায় পূর্ণ হইয়া উঠিল। আনন্দময়ী হঠাৎ এক সময়ে নিশ্বাস ফেলিয়া বলিয়া উঠিলেন, “সুচরিতার সঙ্গে যদি গোরার বিয়ে হতে পারে তো বড়ো খুশি হই।” - লাফাইয়া উঠিল, কহিল, “মা, এ কথা আমি অনেক বার ভেবেছি। ঠিক গোরার উপযুক্ত আনন্দময়ী । কিন্তু হবে কি ? বিনয় । কেন হবে না ? আমার মনে হয় গোরা যে সুচরিতাকে পছন্দ করে না তা নয়। গোরার মন যে কোনো এক জায়গায় আকৃষ্ট হইয়াছে আনন্দময়ীর কাছে তাহা অগোচর ছিল না। সে মেয়েটি যে সুচরিতা তাহাও তিনি বিনয়ের নানা কথা হইতে সংগ্ৰহ করিয়াছিলেন। খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া আনন্দময়ী কহিলেন, “কিন্তু সুচরিতা কি হিন্দুর ঘরে বিয়ে করবে ?” বিনয় কহিল, “আচ্ছা মা, গোরা কি ব্ৰাহ্মার ঘরে বিয়ে করতে পারে না ? তোমার কি তাতে মত নেই ?” আনন্দময়ী। আমার খুব মত আছে। আনন্দময়ী কহিলেন, “আছে বৈকি বিনু ! মানুষের সঙ্গে মানুষের মনের মিল নিয়েই বিয়ে- সে সময়ে কোন মন্তরটা পড়া হল তা নিয়ে কী আসে যায় বাবা ! যেমন করে হােক ভগবানের নামটা নিলেই হল ।” বিনয়ের মনের ভিতর হইতে একটা ভার নামিয়া গেল। সে উৎসাহিত হইয়া কহিল, “মা, তোমার মুখে যখন এ-সব কথা শুনি আমার ভারি আশ্চর্য বোধ হয়। এমন ঔদার্য তুমি পেলে কোথা থেকে !" আনন্দময়ী হাসিয়া কহিলেন, “গোরার কাছ থেকে পেয়েছি।” বিনয় কহিল, “গোরা তো এর উলটো কথাই বলে ।” আনন্দময়ী। বললে কী হবে। আমার যা-কিছু শিক্ষা সব গোরা থেকেই হয়েছে। মানুষ বস্তুটি যে কত সত্য— আর মানুষ যা নিয়ে দলাদলি করে, ঝগড়া করে মরে, তা যে কত মিথ্যে- সে কথা ভগবান গোরাকে যেদিন দিয়েছেন সেইদিনই বুঝিয়ে দিয়েছেন। বাবা, ব্ৰাহ্মই বা কে আর হিন্দুই বা কে । মানুষের হৃদয়ের তো কোনো জাত নেই- সেইখানেই ভগবান সকলকে মেলান এবং নিজে এসেও মেলেন। তাকে ঠেলে দিয়ে মন্তর আর মতের উপরেই মেলাবার ভার দিলে চলে কি ?" বিনয় আনন্দময়ীর পায়ের ধূলা লইয়া কহিল, “মা, তোমার কথা আমার বড়ো মিষ্টি লাগল। আমার দিনটা আজ সার্থক হয়েছে।” w