পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(S O J রবীন্দ্র-রচনাবলী মনোরমা যতদিন বঁাচিয়া ছিল ততদিন আমি দেবীরদের কোনো কথায় ভুলি নাই । আমার বিষয়ের অধিকার লইয়া যতদূর সাধ্য তাঁহাদের সঙ্গে লড়িয়াছি। আমি যতদিন বাচি মনোরমার জন্য টাকা সঞ্চয় করিয়া তাহাকে দিয়া যাইব, এই আমার পণ ছিল । আমি আমার কন্যার জন্য তাহাদের মনে হইত আমি তাঁহাদেরই ধন চুরি করিতেছি । নীলকান্ত বলিয়া কর্তার একজন পুরাতন বিশ্বাসী কর্মচারী ছিল, সেই আমার সহায় ছিল । আমি যদি বা আমার প্রাপ্য কিছু, ছাড়িয়া দিয়া আপসে নিস্পত্তির চেষ্টা করিতাম। সে কোনোমতেই রাজি হইত না ; সে বলিত— আমাদের হকের এক পয়সা কে লয় দেখিব । এই হকের লড়াইয়ের মাঝখানেই আমার কন্যার মৃত্যু হইল। তাহার পরদিনেই আমার মেজো দেবর আসিয়া আমাকে বৈরাগ্যের উপদেশ দিলেন । বলিলেন- বউদিদি, ঈশ্বর তোমার যা অবস্থা করিলেন তাহাতে তোমার আর সংসারে থাকা উচিত হয় না । যে কয়দিন বঁাচিয়া থাক তীর্থে গিয়া ধৰ্মকর্মে মন দাও, আমরা তোমার খাওয়াপরার বন্দোবস্ত করিয়া দিব । আমি আমাদের গুরুঠাকুরকে ডাকিয়া পাঠাইলাম । বলিলাম— ঠাকুর, অসহ্য দুঃখের হাত হইতে কী করিয়া বাচিব আমাকে বলিয়া দাও— উঠিতে বসিতে আমার কোথাও কোনো সাস্তুনা নাই— আমি যেন বেড়া-আগুনের মধ্যে পড়িয়াছি ; যেখানেই যাই, যে দিকেই ফিরি, কোথাও আমার যন্ত্রণার এতটুকু অবসানের পথ দেখিতে পাই না । গুরু আমাকে আমাদের ঠাকুর-ঘরে লইয়া গিয়া কহিলেন– এই গোপীবল্লভাই তোমার স্বামী পুত্ৰ কন্যা সবই । ইহার সেবা করিয়াই তোমার সমস্ত শূন্য পূর্ণ হইবে । আমি দিনরাত ঠাকুর-ঘরেই পড়িয়া রহিলাম । ঠাকুরকেই সমস্ত মন দিবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম, কিন্তু তিনি নিজে না লইলে আমি দিব কেমন করিয়া ? তিনি লইলেন কই ? নীলকান্তকে ডাকিয়া কহিলাম- নীলুদাদা, আমার জীবনস্বত্ব আমি দেবীরদেরই লিখিয়া দিব স্থির করিয়াছি। তাহারা খোরাকি-বাবদ মাসে মাসে কিছু করিয়া টাকা দিবে। নীলকান্ত কহিল- সে কখনো হইতেই পারে না । তুমি মেয়েমানুষ, এ-সব কথায় থাকিয়ো ୩ | আমি বলিলাম— আমার আর. সম্পত্তিতে প্রয়োজন কী ? নীলকান্ত কহিল- তা বলিলে কি হয় ! আমাদের যা হক তা ছাড়িব কেন ? এমন পাগলামি করিয়ো না । নীলকান্ত হকের চেয়ে বড়ো আর কিছুই দেখিতে পায় না। আমি বড়ো মুশকিলেই পড়িলাম। বিষয়কর্ম আমার কাছে বিষের মতো ঠেকিতেছে- কিন্তু জগতে আমার ঐ একমাত্র বিশ্বাসী নীলকান্তই আছে, তাহার মনে আমি কষ্ট দিই। কী করিয়া ! সে যে বহু দুঃখে আমার ঐ এক ‘হক' বঁাচাইয়া আসিয়াছে । শেষকালে একদিন নীলকান্তকে গোপন করিয়া একখানা কাগজে সহি দিলাম। তাহাতে কী যে লেখা ছিল তাহা ভালো করিয়া বুঝিয়া দেখি নাই। আমি ভাবিয়ছিলাম, আমার সই করিতে ভয় কী— আমি এমন কী রাখিতে চাই যাহা আর-কেহ ঠকাইয়া লইলে সহ্য হইবে না ! সবই তো আমার শ্বশুরের, তাহার ছেলেরা পাইবে, পাক । লেখাপড়া রেজেস্ট্রি হইয়া গেলে আমি নীলকান্তকে ডাকিয়া কহিলাম- নীলুদাদা, রাগ করিয়ো না, আমার যাহা-কিছু ছিল লিখিয়া পড়িয়া দিয়াছি। আমার কিছুতেই প্রয়োজন নাই। নীলকান্ত অস্থির হইয়া উঠিয়া কহিল- আঁ্যা, করিয়াছ কী ! যখন দলিলের খসড়া পড়িয়া দেখিল সত্যই আমি আমার সমস্ত স্বত্ব ত্যাগ করিয়াছি তখন নীলকান্তের ক্রোধের সীমা রহিল না। তাহার প্রভুর মৃত্যুর পর হইতে আমার ঐ ‘হক' বঁাচানোই তাহার জীবনের একমাত্র অবলম্বন ছিল । তাহার সমস্ত বুদ্ধি সমস্ত শক্তি ইহাতেই অবিশ্রাম