পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা (N) ইহাতেই সে সুখ পাইয়াছে- এমন-কি, তাহার নিজের ঘরের কাজ দেখিবারও সময় ছিল না । সেই “হক যখন নির্বোিধ মেয়েমানুষের কলমের এক আঁচড়েই উড়িয়া গেল তখন নীলকান্তকে শান্ত করা অসম্ভব হইয়া উঠিল । সে কহিল— যাক, এখানকার সঙ্গে আমার সমস্ত সম্বন্ধ চুকিল, আমি চলিলাম। অবশেষে নীলুদাদা এমন করিয়া রাগ করিয়া আমার কােছ হইতে বিদায় হইয়া যাইবে শ্বশুরবাড়ির ভাগ্যে এই কি আমার শেষ লিখন ছিল ! আমি তাহাকে অনেক মিনতি করিয়া , ডাকিয়া বলিলাম— দাদা, আমার উপর রাগ করিয়ো না। আমার কিছু জমানে টাকা আছে তাহা হইতে তোমাকে এই পাঁচশো টাকা দিতেছি— তোমার ছেলের বউ যেদিন আসিবে সেইদিন আমার আশীর্বাদ জানাইয়া এই টাকা হইতে তাহার গহনা গড়াইয়া দিয়ো । নীলকান্ত কহিল- আমার আর টাকায় প্রয়োজন নাই। আমার মনিবের সবই যখন গোল তখন ও পাঁচশো টাকা লইয়া আমার সুখ হইবে না। ও থাক । এই বলিয়া আমার স্বামীর শেষ অকৃত্রিম বন্ধু আমাকে ছাড়িয়া চলিয়া গেল। আমি ঠাকুর-ঘরে আশ্রয় লইলাম। আমার দেবীররা বলিল- তুমি তীর্থবাসে যাও। আমি কহিলাম— আমার শ্বশুরের ভিটাই আমার তীর্থ, আর আমার ঠাকুর যেখানে আছে সেইখানেই আমার আশ্ৰয় | কিন্তু আমি যে বাড়ির কোনো অংশ অধিকার করিয়া থাকি তাহাও তাঁহাদের পক্ষে অসহ্য হইতে লাগিল। তাহারা ইতিমধ্যেই আমাদের বাড়িতে জিনিসপত্র আনিয়া কোন ঘর কে কী ভাবে ব্যবহার করিবে তাহা সমস্তই ঠিক করিয়া লইয়াছিল । শেষকালে তাহারা বলিলতোমার ঠাকুর তুমি লইয়া যাইতে পারে, আমরা তাহাতে আপত্তি করিব না। যখন তাহাতেও আমি সংকোচ করিতে লাগিলাম তখন তাহারা কহিল- এখানে তোমার খাওয়াপরা চলিবে কী করিয়া ? আমি বলিলাম— কেন, তোমরা যা খোরাকি বরাদ্দ করিয়াছ তাহাতেই আমার যথেষ্ট হইবে । তাহারা কহিল- কই, খোরাকির তো কোনো কথা নাই । তাহার পর আমার ঠাকুর লইয়া আমার বিবাহের ঠিক চৌত্ৰিশ বৎসর পরে একদিন শ্বশুরবাড়ি হইতে বাহির হইয়া পড়িলাম। নীলুদাদার সন্ধান লইতে গিয়া শুনিলাম, তিনি আমার পূর্বেই বৃন্দাবনে চলিয়া গেছেন। গ্রামের তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে আমি কাশীতে গেলাম। কিন্তু পাপমনে কোথাও শান্তি পাইলাম না। ঠাকুরকে প্রতিদিন ডাকিয়া বলি, ঠাকুর, আমার স্বামী, আমার ছেলেমেয়ে আমার কাছে যেমন সত্য ছিল তুমি আমার কাছে তেমনি সত্য হয়ে ওঠে ! কিন্তু কই, তিনি তো আমার প্রার্থনা শুনিলেন না। আমার বুক যে জুড়ায় না, আমার সমস্ত শরীর-মন যে কঁদিতে থাকে। বাপ রে বাপ ! মানুষের প্রাণ কী কঠিন! সেই আট বৎসর বয়সে শ্বশুরবাড়ি গিয়াছি, তাহার পরে একদিনের জন্যও বাপের বাড়ি কোনো ফল হয় নাই। তাহার পর বাবার চিঠিতে তোমাদের জন্মের সংবাদ পাইলাম, আমার বােনের মৃত্যুসংবাদও পাইয়াছি। মায়ের-কোল-ছাড়া তােদের যে আমার কোলে টানিব, ঈশ্বর এপর্যন্ত এমন সুযোগ ঘটান নাই। : তীর্থে ঘুরিয়া যখন দেখিলাম মায়া এখনাে মন ভরিয়া আছে, কোনো-একটা বুকের : জিনিসকে পাইবার জন্য বুকের তৃষ্ণা এখনাে মরে নাই— তখন তোদের খোজ করিতে লাগিলাম। শুনিয়াছিলাম তোদের বাপ ধর্ম ছাড়িয়া, সমাজ ছাড়িয়া বাহির হইয়া