পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা GSG দের ছোওয়া খান না ।” “সুচরিতাও হিন্দু হয়ে উঠল! কালে কালে কতই যে দেখতে হবে তাই ভাবি ।” হরিমোহিনী ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিতেন, “রাধারানী মা, যাও মা ! তুমি খেতে যাও মা !” দলের লোকের কাছে যে সুচরিতা তাহার জন্য এমন করিয়া খোটা খাইতেছে ইহা তঁহার কাছে অত্যন্ত কষ্টকর হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু সুচরিতা অটল হইয়া থাকিত। একদিন কোনাে ব্ৰাহ্ম মেয়ে কৌতুহলবশত হরিমোহিনীর ঘরের মধ্যে জুতা লইয়া প্রবেশ করিতে প্রবৃত্ত হইলে সুচরিতা পথরোধ করিয়া দাড়াইয়া বলিল, “ও ঘরে যেয়ে না।” “কেন ?” “ও ঘরে ওঁর ঠাকুর আছে।” “ঠাকুর আছে! তুমি বুঝি। রোজ ঠাকুর-পুজো কর।” হরিমোহনী বলিলেন, “ই মা, পুজো করি বৈকি।” “ঠাকুরকে তোমার ভক্তি হয় ?” “পোড়া কপাল আমার ! ভক্তি আর কই হল! ভক্তি হলে তো বেঁচেই যৌতুম।” সেদিন ললিতা উপস্থিত ছিল। সে মুখ লাল করিয়া প্রশ্নকারিণীকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি র্যার উপাসনা কর তাকে ভক্তি করা ?” “বাঃ, ভক্তি করি নে তো কী !” ললিতা সবেগে মাথা নাড়িয়া কহিল, “ভক্তি তো করই না, আর ভক্তি যে কর না সেটা তোমার জানাও নেই ।” সুচরিতা যাহাতে আচার-ব্যবহারে তাহার দল হইতে পৃথক না হয় সেজন্য হরিমােহিনী অনেক চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। ইতিপূর্বে হারানবাবুতে বরদাসুন্দরীতে ভিতরে ভিতরে একটা বিরোধের ভাবই ছিল। বর্তমান । ব্যাপারে উভয়ের মধ্যে খুব মিল হইল। বরদাসুন্দরী কহিলেন— যিনি যাই বলুন-না কেন, ব্রাহ্মসমাজের আদর্শকে বিশুদ্ধ রাখিবার জন্য যদি কাহারও দৃষ্টি থাকে তাে সে পানুবাবুর। হারানবাবুও— ব্ৰহ্মপরিবারকে সর্বপ্রকারে নিষ্কলঙ্ক রাখিবার প্রতি বরদাসুন্দরীর একান্ত বেদনাপূর্ণ সচেতনতাকে ব্ৰাহ্মগৃহিণীমাত্রেরই পক্ষে একটি সুদৃষ্টান্ত বলিয়া সকলের কাছে প্রকাশ করিলেন। তাহার এই প্রশংসার মধ্যে পরেশবাবুর প্রতি বিশেষ একটু খোচা ছিল। হারানবাবু একদিন পরেশবাবুর সম্মুখেই সুচরিতাকে কহিলেন, “শুনলুম নাকি আজকাল তুমি ঠাকুরের প্রসাদ খেতে আরম্ভ করেছ।” সুচরিতার মুখ লাল হইয়া উঠিল, কিন্তু যেন সে কথাটা শুনিতেই পাইল না। এমনিভাবে টেবিলের উপরকার দোয়াতদানিতে কলামগুলা গুছাইয়া রাখিতে লাগিল । পরেশবাবু একবার করুণনেত্ৰে মুক্ত মুখ দিকে চাহিয়া হকা-বাবুরু করলেন স্মার আল ফন্সি এই সাঁই তাে রর প্রসাদ ।” হারানবাবু কহিলেন, “কিন্তু সুচরিতা যে আমাদের ঠাকুরকে পরিত্যাগ করবার উদ্যোগ করছেন।” পরেশবাবু কহিলেন, “তাও যদি সম্ভব হয় তবে তা নিয়ে উৎপাত করলে কি তার কোনো প্রতিকার হবে ?” হারানবাবু কহিলেন, “স্রোতে যে লোক ভেসে যাচ্ছে তাকে কি ডাঙায় তোেলবার চেষ্টাও করতে হবে না ?” পরেশবাবু কহিলেন, “সকলে মিলে তার মাথার উপর ঢেলা ছুড়ে মারাকেই ডাঙায় তোেলবার চেষ্টা বলা যায় না। পানুবাবু, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি এতটুকুবেলা থেকেই সুচরিতাকে দেখে আসছি। ও যদি জলেই পড়ত তা হলে আমি আপনাদের সকলের আগেই জানতে পারতুম এবং আমি উদাসীন থাকতুম না।”