পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

( ՀԵ রবীন্দ্র-রচনাবলী কহিল, “তোমার সঙ্গে পানুবাবুর যে কথা আছে!” সুচরিতা তাহার কোনো উত্তর না করিয়া ললিতার আঁচল চাপিয়াই রহিল— তখন ললিতা সুচরিতার আসনের এক পাশে বসিয়া পড়িল। - হারানবাবু কোনো বাধাতেই দমিবার পাত্র নহেন । তিনি আর ভূমিকমাত্র না করিয়া একেবারে কথাটা পাড়িয়া বসিলেন । কহিলেন, “আমাদের বিবাহে আর বিলম্ব হওয়া উচিত মনে করি নে। পরেশবাবুকে জানিয়েছিলাম ; তিনি বললেন, তোমার সম্মতি পেলেই আর কোনো বাধা থাকবে না। আমি স্থির করেছি, আগামী রবিবারের পরের রবিবারেই”- সুচরিতা কথা শেষ করিতে না দিয়াই কহিল, “না।” সুচরিতার মুখে এই অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সুস্পষ্ট এবং উদ্ধত “না” শুনিয়া হারানবাবু থমকিয়া গেলেন। সুচরিতাকে তিনি অত্যন্ত বাধ্য বলিয়া জানিতেন। সে যে একমাত্র “না” বাণের দ্বারা তাহার প্রস্তাবটিকে এক মুহুর্তে অর্ধপথে ছেদন করিয়া ফেলিবে, ইহা তিনিও মনে করেন নাই। তিনি বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “না ! না মানে কী ? তুমি আরো দেরি করতে চাও ?” সুচরিতা কহিল, “না।” হারানবাবু বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “তবে ?” সুচরিতা মাথা নত করিয়া কহিল, “বিবাহে আমার মত নেই।” হারানবাবু, হতবুদ্ধির ন্যায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “মত নেই ? তার মানে ?” ললিতা ঠোকর দিয়া কহিল, “পানুবাবু, আপনি আজ বাংলা ভাষা ভুলে গেলেন নাকি ?” হারানবাবু কঠোর দৃষ্টির দ্বারা ললিতাকে আঘাত করিয়া কহিলেন, “বরঞ্চ মাতৃভাষা ভুলে গেছি এ | কথা স্বীকার করা সহজ, কিন্তু যে মানুষের কথায় বরাবর শ্রদ্ধা করে এসেছি তাকে ভুল বুঝেছি এ কথা স্বীকার করা সহজ নয় ।” ললিতা কহিল, “মানুষকে বুঝতে সময় লাগে, আপনার সম্বন্ধেও হয়তো সে কথা খাটে ।” হারানবাবু কহিলেন, “প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত আমার কথার বা মতের বা ব্যবহারের কোনো ব্যত্যয় ঘটে নি— আমি আমাকে ভুল বোঝবার কোনো উপলক্ষ কাউকে দিই নি এ কথা আমি জোরের সঙ্গে বলতে পারি— সুচরিতাই বলুন আমি ঠিক বলছি কি না।” ললিতা আবার কী একটা উত্তর দিতে যাইতেছিল— সুচরিতা তাহাকে থামাইয়া দিয়া কহিল, “আপনি ঠিক বলেছেন । আপনাকে আমি কোনো দোষ দিতে চাই নে ৷” হারানবাবু কহিলেন, “দোষ যদি না দেবে। তবে আমার প্রতি অন্যায়ই বা করবে কেন ?" সুচরিতা দৃঢ়স্বরে কহিল, “যদি একে অন্যায় বলেন তবে আমি অন্যায়ই করব।— কিন্তু—” বাহির হইতে ডাক আসিল, “দিদি, ঘরে আছেন ?” সুচরিতা উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়া তাড়াতাড়ি কহিল, “আসুন, বিনয়বাবু, আসুন ।” “ভুল করছেন দিদি, বিনয়বাবু আসেন নি, আমি বিনয় মাত্র, আমাকে সমাদর করে লজ্জা দেবেন। না”— বলিয়া বিনয় ঘরে প্রবেশ করিয়াই হারানবাবুকে দেখিতে পাইল । হারানবাবুর মুখের অপ্ৰসন্নতা লক্ষ্য করিয়া কহিল, “অনেক দিন আসি নি বলে রাগ করেছেন বুঝি !” হারানবাবু পরিহাসে যোগ দিবার চেষ্টা করিয়া কহিলেন, “রাগ করবারই কথা বটে। কিন্তু আজ আপনি একটু অসময়ে এসেছেন- সুচরিতার সঙ্গে আমার একটা বিশেষ কথা হচ্ছিল |” বিনয় শশব্যস্ত হইয়া উঠিল ; কহিল, “ঐ দেখুন, আমি কখন এলে যে অসময়ে আসা হয় না তা আমি আজ পর্যন্ত বুঝতেই পারলুম না ! এইজন্যই আসতে সাহসই হয় না।” বলিয়া বিনয় বাহির হইয়া যাইবার উপক্ৰম করিল। সুচরিতা কহিল, “বিনয়বাবু, যাবেন না। আমাদের যা কথা ছিল শেষ হয়ে গেছে। আপনি বসুন।” বিনয় বুঝিতে পারিল সে আসতে সুচরিতা একটা বিশেষ সংকট হইতে পরিত্রাণ পাইয়াছে। খুশি হইয়া একটা চৌকিতে বসিয়া পড়িল এবং কহিল, “আমাকে প্রশ্রয় দিলে আমি কিছুতেই সামলাতে