পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা Qぐ)○ না। আপনার পরিবারে আজকাল যে-সব ব্যাপার আরম্ভ হয়েছে। এ যে সমস্তই আপনার অবিবেচনার ফুল, এ কথা আমি আপনাকে মুখের সামনেই বলছি।” পরেশবাবু ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “এ তে আপনি ঠিক কথাই বলছেন- আমার পরিবারের সমস্ত ফলাফলের দায়িত্ব আমি নেব না তো কে নেবে ?” হারানবাবু কহিলেন, “এজন্যে আপনাকে অনুতাপ করতে হবে- সে আমি বলে রাখছি।” পরেশবাবু কহিলেন, “অনুতাপ তো ঈশ্বরের দয়া। অপরাধকেই ভয় করি, পানুবাবু, অনুতাপকে নয় ।” হয়েছে ।” পরেশবাবু কহিলেন, “পানুবাবু, তবে কি একটু বসবেন ?” হারানবাবু কহিলেন, “না।” বলিয়া দ্রুতপদে চলিয়া গেলেন । 8S একই সময়ে নিজের অন্তরের সঙ্গে, আবার নিজের বাহিরের সঙ্গে সুচরিতার যে সংগ্রাম বাধিয়া উঠিয়াছে তাহাতে তাহাকে ভীত করিয়া তুলিয়াছে। গোরার প্রতি তাহার যে মনের ভাব এতদিন তাহার অলক্ষ্যে বল পাইয়া উঠিয়াছিল এবং গোরার জেলে যাওয়ার পর হইতে যাহা তাহার নিজের কাছে সম্পূর্ণ সুস্পষ্ট এবং দুনিবাররূপে দেখা দিয়াছে তাহা লইয়া সে যে কী করিবে, তাহার পরিণাম যে কী, তাহা সে কিছুই ভাবিয়া পায় না— সে কথা কাহাকেও বলিতে পারে না, নিজের কাছে নিজে কুষ্ঠিত হইয়া থাকে। এই নিগুঢ় বেদনটাকে লইয়া সে গোপনে বসিয়া নিজের সঙ্গে যে একটা বোঝাপড়া করিয়া লইবে তাহার সে নিভৃত অবকাশটুকুও নাই— হারানবাবু তাহার দ্বারের কাছে তীহাদের সমস্ত সমাজকে জাগ্ৰত করিয়া তুলিবার উপক্ৰম করিয়াছেন, এমন-কি, ছাপার কাগজের ঢাকেও কাঠি পড়িবার লক্ষণ দেখা যাইতেছে। ইহার উপরেও তাহার মাসির সমস্যা এমন হইয়া উঠিয়াছে যে অতি সত্বর তাহার একটা কোনো মীমাংসা না করিলে একদিনও আর চলে না। সুচরিতা বুঝিয়াছে এবার তাহার জীবনের একটা সন্ধিক্ষণ আসিয়াছে, চিরপরিচিত পথে চিরাভ্যস্ত নিশ্চিন্তভাবে চলিবার দিন আর নাই । এই তাহার সংকটের সময় তাহার একমাত্র অবলম্বন ছিল। পরেশবাবু। তাহার কাছে সে পরামর্শ চাহে নাই, উপদেশ চাহে নাই ; অনেক কথা ছিল যাহা পরেশবাবুর সম্মুখে সে উপস্থিত করিতে পারিত নী এবং এমন অনেক কথা ছিল যাহা লজ্জাকর হীনতাবশতই পরেশবাবুর কাছে প্রকাশের অযোগ্য । কেবল পরেশবাবুর জীবন, পরেশবাবুর সঙ্গমাত্র তাহাকে যেন নিঃশব্দে কোন পিতৃক্ৰোড়ে কোন মাতৃবক্ষে আকর্ষণ করিয়া লইত । এখন শীতের দিনে সন্ধ্যার সময় পরেশবাবু বাগানে যাইতেন না। বাড়ির পশ্চিম দিকের একটি ছোটাে ঘরে মুক্ত দ্বারের সম্মুখে একখানি আসন পাতিয়া তিনি উপাসনায় বসিতেন, তাহার শুরুকেশমণ্ডিত শাস্তমুখের উপর সূর্যাস্তের আভা আসিয়া পড়িত। সেই সময়ে সুচরিতা নিঃশব্দপদে }প করিয়া তাহার কাছে আসিয়া বসিত। নিজের অশান্ত ব্যথিত চিত্তটিকে সে যেন পরেশের উপাসনার গভীরতার মাঝখানে নিমজ্জিত করিয়া রাখিত। আজকাল উপাসনান্তে প্রায়ই পরেশ দেখিতে পাইতেন তাহার এই কন্যাটি, এই ছাত্রীটি স্তব্ধ হইয়া তাহার কাছে বসিয়া আছে ; তখন তিনি একটি অনির্বচনীয় আধ্যাত্মিক মধুর্যের দ্বারা এই বালিকাটিকে পরিবেষ্টিত দেখিয়া সমস্ত অন্তঃকরণ দিয়া নিঃশব্দে ইহাকে আশীৰ্বাদ করিতেন। উইমার সহিত মিলনকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য করিয়াছিলেন বলিয়া যাহা শ্ৰেয়তম এবং সত্যতম পরিশের চিত্ত সর্বদাই তাহার অভিমুখ ছিল। এইজন্য সংসার কোনােমতেই তাহার কাছে অত্যন্ত