পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(፩\98 রবীন্দ্র-রচনাবলী গুরুতর হইয়া উঠিতে পারিত না । এইরূপে নিজের মধ্যে তিনি একটি স্বাধীনতা লাভ করিয়াছিলেন। বলিয়াই মত বা আচরণ লইয়া তিনি অন্যের প্রতি কোনোপ্রকার জবরদস্তি করিতে পারিতেন না। মঙ্গলের প্রতি নির্ভর এবং সংসারের প্রতি ধৈর্য র্তাহার পক্ষে অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল । ইহা তাহার এত অধিক পরিমাণে ছিল যে সাম্প্রদায়িক লোকের কাছে তিনি নিন্দিত হইতেন, কিন্তু নিন্দাকে তিনি এমন করিয়া গ্রহণ করিতে পারিতেন যে হয়তো তাহা তাহাকে আঘাত করিত, কিন্তু তাহাকে বিদ্ধ করিয়া থাকিত না । তিনি মনের মধ্যে এই কথাটাই কেবলই থাকিয়া থাকিয়া আবৃত্তি করিতেন— ‘আমি । আর-কাহারও হাত হইতে কিছুই লইব না, আমি তাহার হাত হইতেই সমস্ত লইব ।” পরেশের জীবনের এই গভীর নিস্তব্ধ শান্তির স্পর্শ লাভ করিবার জন্য আজকাল সুচরিতা নানা উপলক্ষেই তাহার কাছে আসিয়া উপস্থিত হয় । এই অনভিজ্ঞ বালিকাবয়সে তাহার বিরুদ্ধ হৃদয় এবং বিরুদ্ধ সংসার যখন তাহাকে একেবারে উদভ্ৰান্ত করিয়া তুলিয়াছে তখন সে বার বার কেবল মনে করিয়াছে, “বাবার পা দুখানা মাথায় চাপিয়া ধরিয়া খানিকক্ষণের জন্য যদি মাটিতে পড়িয়া থাকিতে পারি। তবে আমার মন শান্তিতে ভরিয়া উঠে ।” এইরূপে সুচরিতা মনে ভাবিতেছিল, সে মনের সমস্ত শক্তিকে জাগ্ৰত করিয়া অবিচলিত ধৈর্যের সহিত সমস্ত আঘাতকে ঠেকাইয়া রাখিবে, অবশেষে সমস্ত প্রতিকূলতা আপনি পরাস্ত হইয়া যাইবে । কিন্তু সেরূপ ঘটিল না, তাহাকে অপরিচিত পথে বাহির হইতে হইল । বরদাসুন্দরী যখন দেখিলেন রাগ করিয়া, ভৎসনা করিয়া, সুচরিতাকে টলানো সম্ভব নহে এবং পরেশকেও সহায়রাপে পাইবার কোনো আশা নাই, তখন হরিমোহিনীর প্রতি তাহার ক্ৰোধ অত্যন্ত দুৰ্ভুক্ত প্লয়া উঠিল। ঠােয়র গৃহের মনে হরমােহিনীর অস্তিত্ব উহারে উঠতে বসিতে ঘল দর १ळला | সেদিন তাহার পিতার মৃত্যুদিনের বার্ষিক উপাসনা উপলক্ষে তিনি বিনয়কে নিমন্ত্ৰণ করিয়াছিলেন। উপাসনা সন্ধ্যার সময় হইবে, তৎপূর্বেই তিনি সভাগৃহ সাজাইয়া রাখিতেছিলেন ; সুচরিতা এবং অনা মেয়েরাও তাহার সহায়তা করিতেছিল । এমন সময় তাহার চোখে পড়িল বিনয় পাশের সিঁড়ি দিয়া উপরে হরিমোহিনীর নিকট যাইতেছে। মন যখন ভারাক্রান্ত থাকে তখন ক্ষুদ্র ঘটনাও বড়ো হইয়া উঠে। বিনয়ের এই উপরের ঘরে যাওয়া এক মুহূর্তে র্তাহার কাছে এমন অসহ্য হইয়া উঠিল যে তিনি ঘর সাজানাে ফেলিয়া তৎক্ষণাৎ হরিমোহিনীর কাছে গিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, বিনয় মাদুরে বসিয়া আত্মীয়ের ন্যায় বিশ্রাব্ধভাবে হরিমোহিনীর সহিত কথা কহিতেছে। বরদাসুন্দরী বলিয়া উঠিলেন, “দেখো, তুমি আমাদের এখানে যতদিন খুশি থাকে, আমি তোমাকে আদর-যত্ন করেই রাখব। কিন্তু আমি বলছি, তোমার ঐ ঠাকুরকে এখানে রাখা চলবে না।” হরিমোহিনী চিরকাল পাড়াগায়েই থাকিতেন। ব্ৰাহ্মদের সম্বন্ধে তাহার ধারণা ছিল যে, তাহার খৃস্টানেরই শাখাবিশেষ, সুতরাং তাঁহাদেরই সংস্রব সম্বন্ধে বিচার করিবার বিষয় আছে। কিন্তু তাহারাও যে র্তাহার সম্বন্ধে সংকোচ অনুভব করিতে পারে। ইহা তিনি এই কয়দিনে ক্রমশই বুঝিতে পারিতেছিলেন। কী করা কর্তব্য ব্যাকুল হইয়া চিন্তা করিতেছিলেন, এমন সময়ে আজ বরদাসুন্দরীর মুখে এই কথা শুনিয়া তিনি বুঝিলেন যে, আর চিন্তা করিবার সময় নাই- যাহা হয় একটা-কিছু স্থির ২ করিতে হইবে । প্ৰথমে ভাবিলেন কলিকাতায় একটা কোথাও বাসা লইয়া থাকিবেন, তাহা হইলে মাঝে মুকুতা ও সতীশকে দেখিতে পাইনে। কিন্তু ঠােয়র যে প্রশ্ন সম্বল তাহাতে কলকাতার ঋণ বরদাসুন্দরী অকস্মাৎ ঝড়ের মতো আসিয়া যখন চলিয়া গেলেন, তখন বিনয় মাথা হেঁট করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল । কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া হরিমোহিনী বলিয়া উঠিলেন, “আমি তীর্থে যাব, তোমরা কেউ আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারবে বাবা ?”