পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(88 রবীন্দ্র-রচনাবলী কোনোমতে আজ সকালবেলাকার মধ্যেই খুব কড়া রকম করিয়া বোঝাপড়া করিয়া লইতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন। আজ সমস্ত সংকোচ তিনি দূর করিয়াই আসিয়াছিলেন— কিন্তু অপর পক্ষেও যে এমন করিয়া সংকোচ দূর করিতে পারে, ললিতা-সুচরিতাও যে হঠাৎ তৃণ হইতে অস্ত্ৰ বাহির করিয়া দাড়াইবে তাহা তিনি কল্পনাও করেন নাই । তিনি জানিতেন, তাহার নৈতিক অগ্নিবাণ যখন তিনি মহাতেজে নিক্ষেপ করিতে থাকিবেন অপর পক্ষের মাথা একেবারে হেঁট হইয়া যাইবে । ঠিক তেমনটি হইল না— অবসরও চলিয়া গেল। কিন্তু হারানবাবু হার মানিবেন না। তিনি মনে মনে কহিলেন, সত্যের জয় হইবেই, অর্থাৎ হারানবাবুর জয় হইবেই। কিন্তু জয় তো শুধু শুধু হয় না । লড়াই করিতে হইবে। হারানবাবু কোমর বাধিয়া রণক্ষেত্রে প্রবেশ করিলেন। সুচরিতা কহিল, “মাসি, আজ আমি সকলের সঙ্গে একসঙ্গে খাব।— তুমি কিছু মনে করলে চলবে না।” হরিমোহিনী চুপ করিয়া রহিলেন। তিনি মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন সুচরিতা সম্পূর্ণই তাহার হইয়াছে- বিশেষত নিজের সম্পত্তির জোরে স্বাধীন হইয়া সে স্বতন্ত্র ঘর করিতে চলিয়াছে, এখন হরিমোহিনীকে আর কোনো সংকোচ করিতে হইবে না, ষোলো-আনা নিজের মতো করিয়া চলিতে পরিবেন। তাই, আজ যখন সুচরিতা শুচিত বিসর্জন করিয়া আবার সকলের সঙ্গে একত্রে অন্নগ্ৰহণ করিবার প্রস্তাব করিল। তখন তাহার ভালো লাগিল না, তিনি চুপ করিয়া রহিলেন । সুচরিতা তাহার মনের ভাব বুঝিয়া কহিল, “আমি তোমাকে নিশ্চয় বলছি। এতে ঠাকুর খুশি হবেন। সেই আমার অন্তর্যামী ঠাকুর আমাকে সকলের সঙ্গে আজ একসঙ্গে খেতে বলে দিয়েছেন। তঁর কথা না মানলে তিনি রাগ করবেন । তার রাগকে আমি তোমার রাগের চেয়ে ভয় করি ।” যতদিন হরিমোহিনী বরদাসুন্দরীর কাছে অপমানিত হইতেছিলেন ততদিন সুচরিতা তাহার অপমানের অংশ লইবার জন্য র্তাহার আচার গ্রহণ করিয়াছিল এবং আজ সেই অপমান হইতে যখন নিস্কৃতির দিন উপস্থিত হইল। তখন সুচরিতা যে আচার সম্বন্ধে স্বাধীন হইতে দ্বিধা বােধ করিবে না, হরিমোহিনী তাহা ঠিক বুঝিতে পারেন নাই। হরিমোহিনী সুচরিতাকে সম্পূর্ণ বুঝিয়া লন নাই, বােঝাও র্তাহার পক্ষে শক্ত ছিল । হরিমোহিনী সুচরিতাকে স্পষ্ট করিয়া নিষেধ করিলেন না। কিন্তু মনে মনে রাগ করিলেন। ভাবিতে লাগিলেন- “মা গো, মানুষের ইহাতে যে কেমন করিয়া প্রবৃত্তি হইতে পারে তাহা আমি ভাবিয়া পাই না | ব্ৰাহ্মণের ঘরে তো জন্ম বটে !” খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিলেন, “একটা কথা বলি বাছা, যা কর তা কর, তোমাদের ঐ বোহারাটার হাতে জল খেয়ো না ।” গুরুত্ব কহিল,"ঙ্কেন মাসি, ঐ রামদীন বেহারাই তো তার নিজের গোরু দুইয়ে তোমাকে দুধ যায় ।” হরিমোহিনী দুই চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিলেন, “অবাক করলি- দুধ আর জল এক হল !" সুচরিতা হাসিয়া কহিল, “আচ্ছা মাসি, রামদীনের ছোওয়া জল আজ আমি খাব না। কিন্তু সতীশকে যদি তুমি বারণ কর। তবে সে ঠিক তার উলটাে কাজটি করবে।” হরিমোহিনী কহিলেন, “সতীশের কথা আলাদা ।” হরিমোহিনী জানিতেন পুরুষমানুষের সম্বন্ধে নিয়মসংযমের ত্রুটি মাপ করিতেই হয় । 88 হারানবাবু রণক্ষেত্রে প্রবেশ করিলেন। আজ প্ৰায় পনেরো দিন হইয়া গিয়াছে ললিতা স্টীমারে করিয়া বিনয়ের সঙ্গে আসিয়াছে। কথাটা দুই-এক জনের কানে গিয়াছে এবং অল্পে অল্পে ব্যাপ্ত হইবারও চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু সম্প্রতি দুই দিনের মধ্যেই এই সংবাদ শুকনো খড়ে আগুন লাগার মতো ছড়াইয়া পড়িয়াছে।