পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা (?86ł ব্ৰহ্মপরিবারের ধর্মনৈতিক জীবনের প্রতি লক্ষ রাখিয়া এই প্রকারের কদাচারকে যে দমন করা কর্তব্য হারানবাবু তাহা অনেককেই বুঝাইয়াছেন । এ-সব কথা বুঝাইতেও বেশি কষ্ট পাইতে হয় না। যখন আমরা “সত্যের অনুরোধে’ কর্তব্যের অনুরোধে পরের স্বলন লইয়া ঘূণাপ্রকাশ ও দণ্ডবিধান কৱিতে উদ্যত হই, তখন সত্যের ও কর্তব্যের অনুরোধ রক্ষা করা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত ক্লেশকরা হয় না | এইজন্য ব্ৰাহ্মসমাজে হারানবাবু যখন ‘অপ্ৰিয় সত্য ঘোষণা ও “কঠোর কর্তব্য সাধন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন তখন এত বড়ো অপ্রিয়তা ও কঠোরতার ভয়ে তাহার সঙ্গে উৎসাহের সহিত যোগ দিতে অধিকাংশ লোক পরাত্মখ হইল না। ব্ৰাহ্মসমাজের হিতৈষী লোকেরা গাড়ি পালকি ভাড়া করিয়া পরস্পরের বাড়ি গিয়া বলিয়া আসিলেন আজকাল যখন এমন-সকল ঘটনা ঘটিতে আরম্ভ করিয়াছে তখন ব্রাহ্মসমাজের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন। এইসঙ্গে, সুচরিতা যে হিন্দু হইয়াছে এবং হিন্দু মাসির ঘরে আশ্রয় লইয়া যাগযজ্ঞ তপজপ ও ঠাকুরসেবা লইয়া দিন যাপন করিতেছে, এ কথাও পল্লবিত হইয়া উঠিতে লাগিল । অনেক দিন হইতে ললিতার মনে একটা লড়াই চলিতেছিল। সে প্রতি রাত্ৰে শুইতে যাইবার আগে বলিতেছিল "কখনােই আমি হার মানিব না’ এবং প্রতিদিন ঘুম ভাঙিয়া বিছানায় বসিয়া বলিয়াছে ‘কোনোমতেই আমি হার মানিব না । এই-যে বিনয়ের চিন্তা তাহার সমস্ত মনকে অধিকার করিয়া বসিয়াছে, বিনয় নীচের ঘরে বসিয়া কথা কহিতেছে জানিতে পারিলে তাহার হৃৎপিণ্ডের রক্ত উতলা হইয়া উঠিতেছে, বিনয় দুই দিন তাহাদের বাড়িতে না আসিলে অবরুদ্ধ অভিমানে তাহার মন নিপীড়িত এবং সতীশ ফিরিয়া আসিলে বিনয় কী করিতেছিল, বিনয়ের সঙ্গে কী কথা হইল, তাহার আদ্যোপােন্ত সংবাদ সংগ্ৰহ করিবার চেষ্টা করিতেছে- ইহা ললিতার পক্ষে যতই অনিবাৰ্য হইয়া উঠিতেছে ততই পরাভাবের গ্রানিতে তাহাকে অধীর করিয়া তুলিতেছে। বিনয় ও গোরার সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ে বাধা দেন নাই বলিয়া এক-এক বার পরেশবাবুর প্রতি তাহার রাগও হইত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে লড়াই করবে, মরিবে তবু হারিবে না, এই তাহার পণ ছিল। জীবন যে কেমন করিয়া কাটাইবে সে সম্বন্ধে নানাপ্রকার কল্পনা তাহার মনের মধ্যে যাতায়াত করিতেছিল। যুরোপের লোকহিতৈষিণী রমণীদের জীবনচরিতে যে-সকল কীর্তিকাহিনী সে পাঠ করিয়ছিল সেইগুলি তাহার নিজের পক্ষে সাধ্য ও সম্ভবপর বলিয়া মনে হইতে লাগিল । - সে পরেশস্তুকে গিয়া কািল "বাবা, আমি ক কােনাে যেয়েইস্কুল শেখাবার তার দিতে GN 9” পরেশবাবু তাহার মেয়ের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, ক্ষুধাতুর হৃদয়ের বেদনায় তাহার সকরুণ দুটি চক্ষু যেন কাঙাল হইয়া এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেছে। তিনি স্নিগ্ধস্বরে কহিলেন, “কোন পারবে না মা ? কিন্তু তেমন মেয়ে-ইস্কুল কোথায় ?” যে সময়ের কথা হইতেছে তখন মেয়ে-ইস্কুল বেশি ছিল না, সামান্য পাঠশালা ছিল এবং ভদ্রঘরের মেয়েরা শিক্ষয়িত্রীর কাজে তখন অগ্রসর হন নাই। ললিতা ব্যাকুল হইয়া কহিল, “ইস্কুল নেই বাবা ?” পরেশবাবু কহিলেন, “কই, দেখি নে তো।” ললিতা কহিল, “আচ্ছা, বাবা, মেয়েইস্কুল কি একটা করা যায় না ?” পরেশবাবু কহিলেন, “অনেক খরচের কথা এবং অনেক লোকের সহায়তা চাই।” ললিতা জানিত সৎকর্মের সংকল্প জগাইয়া তোলাই কঠিন, কিন্তু তাহা সাধন করিবার পথেও যে এত বাধা তাহা সে পূর্বে ভাবে নাই। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া সে আস্তে আস্তে উঠিয়া । চলিয়া গেল। তাহার এই প্রিয়তম কন্যােটর হৃদয়ের ব্যথা কোনখানে পরেশবাবু তাহাই বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন। বিনয়ের সম্বন্ধে হারানবাবু সেদিন যে ইঙ্গিত করিয়া গিয়াছেন তাহাও তাঁহার মনে পড়িল । দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া নিজেকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন- ‘আমি কি অবিবেচনার কাজ *রিয়াছি ?” তীহার অন্য কোনাে মেয়ে হইলে বিশেষ চিন্তার কারণ ছিল না— কিন্তু ললিতার জীবন