পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা (8. ঘরেই কাজ চালাতে পারব, তোমার উপরের ঘরে আমরা উৎপাত করতে আসব না। তা ভাই ললিতা, যদি ছাত্রী পাওয়া যায় তা হলে আমি রাজি আছি।” ললিত কহিল, “আচ্ছা, দেখাই যাক-না।” হরিমােহিনী বার বার কহিতে লাগিলেন, “মা, সকল বিষয়েই তোমরা খৃস্টানের মতো হলে চলবে কেন ? গৃহস্থ ঘরের মেয়ে ইস্কুলে পড়ায় এ তাে বাপের বয়সে শুনি নি।” পরেশবাবুর ছাতের উপর হইতে আশপাশের বাড়ির ছাতে মেয়েদের মধ্যে আলাপ-পরিচয় চলিত। এই পরিচয়ের একটা মস্ত কণ্টক ছিল, পাশের বাড়ির মেয়েরা এ বাড়ির মেয়েদের এত বয়সে এখনো বিবাহ হইল না বলিয়া প্রায়ই প্রশ্ন এবং বিস্ময় প্রকাশ করিত। ললিতা এই কারণে এই ছাতের আলাপে পারতপক্ষে যোগ দিত না । এই ছাতে ছাতে বন্ধুত্ব-বিস্তারে লাবণ্যই ছিল সকলের চেয়ে উৎসাহী । অন্য বাড়ির সাংসারিক ইতিবৃত্ত সম্বন্ধে তাহার কৌতুহলের সীমা ছিল না। তাহার প্রতিবেশীদের দৈনিক জীবনযাত্রার প্রধান ও অপ্রধান অনেক বিষয়ই দূর হইতে বায়ু-যোগে তাহার নিকট আলোচিত হইত। চিরুনি হন্তে কেশসংস্কার করিতে কবিতে মুক্ত আকাশতলে প্রায়ই তাহার অপরাতুসভা জমিত । ললিতা তাহার সংকল্পিত মেয়ে-ইস্কুলের ছাত্রীসংগ্রহের ভার লাবণ্যের উপর অর্পণ করিল। লাবণ্য ছাতে ছাতে যখন এই প্রস্তাব ঘোষণা করিয়া দিল তখন অনেক মেয়েই উৎসাহিত হইয়া উঠিল । ললিতা খুশি হইয়া সুচরিতার বাড়ির একতলার ঘর ঝাঁট দিয়া, ধুইয়া, সাজাইয়া প্রস্তুত করিতে লাগিল । কিন্তু তাহার ইস্কুলঘর শূন্যই রহিয়া গেল। বাড়ির কর্তারা তীহাদের মেয়েদের ভুলইয়া পড়াইবার ছলে ব্রাহ্মবাড়িতে লইয়া যাইবার প্রস্তাবে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিলেন । এমন-কি, এই উপলক্ষেই যখন তাহারা জানিতে পারিলেন। পরেশবাবুর মেয়েদের সঙ্গে তাঁহাদের মেয়েদের আলাপ চলে তখন তাহাতে বাধা দেওয়াই তাহার কর্তব্য বোধ করিলেন । তাঁহাদের মেয়েদের ছাতে ওঠা বন্ধ হইবার জো হইল। এবং ব্ৰাহ্ম প্রতিবেশীর মেয়েদের সাধু সংকল্পের প্রতি র্তাহারা সাধুভাষা প্রয়োগ করিলেন না। বেচারা লাবণ্য যথাসময়ে চিরুনি হাতে ছাতে উঠিয়া দেখে পার্শ্ববর্তী ছাতগুলিতে নবীনাদের পরিবর্তে প্রবীণদের সমাগম হইতেছে এবং তাহাদের একজনের নিকট হইতেও সে সাদর সম্ভাষণ লাভ করিল। N ললিতা ইহাতেও ক্ষান্ত হইল না। সে কহিল— অনেক গরিব ব্ৰাহ্ম মেয়ের বেথুন ইস্কুলে গিয়া পড়া দুঃসাধ্য, তাহাদের পড়াইবার ভার লইলে উপকার হইতে পরিবে । এইরূপ ছাত্রী-সন্ধানে সে নিজেও লাগিল, সুধীরকেও লাগাইয়া দিল । সেকালে পরেশবাবুর মেয়েদের পড়াশুনার খ্যাতি বহুদূর বিস্তৃত ছিল। এমন-কি, সে খ্যাতি সত্যকেও অনেক দূরে ছাড়াইয়া গিয়াছিল। এজন্য ইহারা মেয়েদের বিনা বেতনে পড়াইবার ভার লাইবেন শুনিয়া অনেক পিতামাতাই খুশি হইয়া উঠিলেন। প্রথমে পাঁচ-ছয়টি মেয়ে লইয়া দুই-চার দিনেই ললিতার ইস্কুল বসিয়া গেল। পরেশবাবুর সঙ্গে এই ইস্কুলের কথা আলোচনা করিয়া ইহার নিয়ম বাধিয়া ইহার আয়োজন করিয়া সে নিজেকে এক মুহূর্ত সময় দিল না। এমন-কি, বৎসরের শেষে পরীক্ষা হইয়া গেলে মেয়েদের কিরূপ প্রাইজ দিতে হইবে তাহা লইয়া লাবণ্যর সঙ্গে ললিতার রীতিমত তর্ক বাধিয়া গেলা- ললিতা যে বইগুলার কথা বলে লাবণ্যর তাহা পছন্দ হয় না, আবার লাবণ্যর সঙ্গে ললিতার পছন্দরও মিল হয় না। পরীক্ষা কে কে করিবে তাহা লইয়াও একটু তর্ক হইয়া গেল। লাবণ্য মোটের উপরে যদিও হারানবাবুকে দেখিতে পারিত না, কিন্তু তাহার পণ্ডিত্যের খ্যাতিতে সে অভিভূত ছিল। হারানবাবু তাহাদের বিদ্যালয়ের পরীক্ষা অথবা শিক্ষা অথবা কোনাে-একটা কাজে নিযুক্ত থাকিলে সেটা যে বিশেষ গৌরবের বিষয় ইহঁবে এ বিষয়ে তাহার সন্দেহমাত্র ছিল না। কিন্তু ললিতা কথাটাকে একেবারেই উড়াইয়া দিল— হারানবাবুর সঙ্গে তাঁহাদের এ বিদ্যালয়ের কোনােপ্রকার সম্বন্ধই থাকিতে পারে না। দুই-তিন দিনের মধ্যেই তাহার ছাত্রীর দল কমিতে কমিতে ক্লাস শূন্য হইয়া গেল। ললিতা তাহার