পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ 8br রবীন্দ্র-রচনাবলী নির্জন ক্লাসে বসিয়া পদশব্দ শুনিবামাত্র ছাত্রী-সম্ভাবনায় সচকিত হইয়া উঠে, কিন্তু কেহই আসে না। এমন করিয়া দুই প্রহর যখন কাটিয়া গেল তখন সে বুঝিল একটা কিছু গোল হইয়াছে। নিকটে যে ছাত্রটি ছিল ললিতা তাহার বাড়িতে গেল। ছাত্রী কঁদোকাদো হইয়া কহিল, “ম আমাকে যেতে দিচ্ছে না ।” মা কহিলেন, অসুবিধা হয়। অসুবিধাটা যে কী তাহা স্পষ্ট বুঝা গেল না। ললিতা অভিমানিনী মেয়ে ; সে অন্য পক্ষে অনিচ্ছার লেশমাত্র লক্ষণ দেখিলে জেদ করিতে বা কারণ জিজ্ঞাসা করিতে পারেই না। সে কহিল, “যদি অসুবিধা হয় তা হলে কাজ কী !” ললিতা ইহার পরে যে বাড়িতে গেল সেখানে স্পষ্ট কথাই শুনিতে পাইল । তাহারা কহিল, “সুচরিতা আজকাল হিন্দু হইয়াছে, সে জাত মানে, তাহার বাড়িতে ঠাকুরপূজা হয়, ইত্যাদি।” ললিত কহিল, “সেজন্য যদি আপত্তি থাকে। তবে নাহয় আমাদের বাড়িতেই ইস্কুল বসবে।” কিন্তু ইহাতেও আপত্তির খণ্ডন হইল না, আরো একটা-কিছু বাকি আছে। ললিতা অন্য বাড়িতে না গিয়া সুধীরকে ডাকাইয়া পাঠাইল । জিজ্ঞাসা করিল, “সুধীর, কী হয়েছে সত্য করে বলে তো।” সুধীর কহিল, “পানুবাবু তোমাদের এই ইস্কুলের বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লেগেছেন।” । ললিতা জিজ্ঞাসা করিল, “কেন, দিদির বাড়িতে ঠাকুরপুজো হয় বলে ?” সুধীর কহিল, “শুধু তাই নয়।” ললিতা অধীর হইয়া কহিল, “আর কী, বলোই-না ।” সুধীর কহিল, “সে অনেক কথা ।” ললিত কহিল, “আমারও অপরাধ আছে বুঝি ?” সুধীর চুপ করিয়া রহিল। ললিতা মুখ লাল করিয়া বলিল, “এ আমার সেই স্টীমার-যাত্রার শাস্তি! যদি অবিবেচনার কাজ করেই থাকি তবে ভালো কাজ করে প্রায়শ্চিত্ত করার পথ আমাদের সমাজে একেবারেই বন্ধ বুঝি ! আমার পক্ষে সমস্ত শুভকর্ম এ সমাজে নিষিদ্ধ ? আমার এবং আমাদের সমাজের আধ্যাত্মিক উন্নতির এই প্ৰণালী তোমরা ঠিক করেছ।” সুধীর কথাটাকে একটু নরম করিবার জন্য কহিল, “ঠিক সেজন্যে নয়। বিনয়বাবুরা পাছে ক্রমে এই বিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন ওঁরা সেই ভয় করেন ।” ললিতা একেবারে আগুন হইয়া কহিল, “সে ভয়, না সে ভাগ্য ! যোগ্যতায় বিনয়বাবুর সঙ্গে তুলনা হয় এমন লোক ওঁদের মধ্যে কজন আছে ?” সুধীর ললিতার রাগ দেখিয়া সংকুচিত হইয়া কহিল, “সে তো ঠিক কথা । কিন্তু বিনয়বাবু তো—” ললিতা | ব্ৰাহ্মসমাজের লোক নন ! সেইজন্যে ব্ৰাহ্মসমাজ তাকে দণ্ড দেবেন। এমন সমাজের জন্যে আমি গৌরব বোধ করি নে । ছাত্রীদের সম্পূর্ণ তিরোধান দেখিয়া, সুচরিতা ব্যাপারখানা কী এবং কাহার দ্বারা ঘটিতেছে তাহা বুঝিতে পারিয়াছিল। সে এ সম্বন্ধে কোনো কথাটি না কহিয়া উপরের ঘরে সতীশকে তাহার আসন্ন পরীক্ষার জন্য প্ৰস্তুত করিতেছিল । সুধীরের সঙ্গে কথা কহিয়া ললিতা সুচরিতার কাছে গেল, কহিল, “শুনেছ ?” সুচরিতা একটু হাসিয়া কহিল, “শুনি নি ; কিন্তু সব বুঝেছি।” ললিতা কহিল, “এ-সব কি সহ্য করতে হবে ?” সুচরিতা ললিতার হাত ধরিয়া কহিল, “সহ্য করাতে তো অপমান নেই। বাবা কেমন করে সব সহ। করেন দেখেছিস তো ?” ললিত কহিল, “কিন্তু সুচিদিদি, আমার অনেক সময় মনে হয় সহ্য করার দ্বারা অন্যায়কে যেন স্বীকার করে নেওয়া হয় । অন্যায়কে সহ্য না করাই হচ্ছে তার প্রতি উচিত ব্যবহার ।” ললিত কহিল, “তা আমি কিছু ভাবি নি— আমি কী করতে পারি তাও জানি নে— কিন্তু