পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(5s QWり〉 ভূহের সন্ধার নিভৃত ধানের শান্তিসম্ভোগ পরিত্যাগ করিয়া যখন চিন্তিতমুখে সুচরিতার ঘরে আসিয়া দুলড়াইলেন, তখন যে-শিশুর খেলা করা উচিত ছিল সেই শিশু পীড়িত হইয়া চুপ করিয়া পড়িয়া থাকিলে মা’র মনে যেমন ব্যথা বাজে সুচরিতার স্নেহপূর্ণ চিত্ত তেমনি ব্যথিত হইয়া উঠিল। পৱেশবাবু মৃদুস্বরে কহিলেন, “রাধে, সব শুনেছ তো ?” সুচরিতা কহিল, “ই বাবা, সব শুনেছি, কিন্তু তুমি অত ভাবিছ কেন ?” পরেশবাবু কহিলেন, “আমি তো আর কিছু ভাবি নে, আমার ভাবনা এই যে, ললিতা যে ঝড়টা জাগিয়ে তুলেছে তার সমস্ত আঘাত সইতে পারবে তো ? উত্তেজনার মুখে অনেক সময় আমাদের মনে অন্ধ স্পর্ধা আসে, কিন্তু একে একে যখন তার ফল ফলতে আরম্ভ হয় তখন তার ভার বহন করবার শক্তি চলে যায়। ললিতা কি সমস্ত ফলাফলের কথা বেশ ভালো করে চিন্তা করে যেটা তার পক্ষে শ্ৰেয় সেইটেই স্থির করেছে ?” : সুচরিতা কহিল, “সমাজের তরফ থেকে কোনো উৎপীড়নে ললিতাকে কোনোদিন পরাস্ত করতে পারবে না, এ আমি তোমাকে জোর করে বলতে পারি।” পরেশ কহিলেন, “আমি এই কথাটা খুব নিশ্চয় করে জানতে চাই যে, ললিতা কেবল রাগের মাথায় বিদ্রোহ করে ঔদ্ধতা প্ৰকাশ করছে না ।” সুচরিতা মুখ নিচু করিয়া কহিল, “না বাবা, তা যদি হত তা হলে আমি তার কথায় একেবারে কানই দিতুম না । ওর মনের মধ্যে যে কথাটা গভীর ভাবে ছিল সেইটেই হঠাৎ ঘা খেয়ে একেবারে বেরিয়ে এসেছে। এখন একে কোনোরকমে চাপচুপি দিতে গেলে ললিতার মতো মেয়ের পক্ষে ভালো হবে না। বাবা, বিনয়বাবু লোক তো খুব ভালো ৷” পরেশবাবু কহিলেন, “আচ্ছা, বিনয় কি ব্ৰাহ্মসমাজে আসতে রাজি হবে ?” সুচরিতা কহিল, “তা ঠিক বলতে পারি নে। আচ্ছা বাবা, একবার গীেরবাবুর মা'র কাছে যাব ?” পরেশবাবু কহিলেন, “আমিও ভাবছিলুম, তুমি গেলে ভালো হয় ।” 8) আনন্দময়ীর বাড়ি হইতে রোজ সকালবেলায় বিনয় একবার বাসায় আসিত । আজ সকালে আসিয়া সে একখানা চিঠি পাইল। চিঠিতে কাহারও নাম নাই। ললিতাকে বিবাহ করিলে বিনয়ের পক্ষে কোনোমতেই তাহা সুখের হইতে পারে না এবং ললিতার পক্ষে তাহা অমঙ্গলের কারণ হইবে এই কথা গহীয়া চিঠিতে দীর্ঘ উপদেশ আছে এবং সকলের শেষে আছে যে, এ সত্ত্বেও যদি বিনয় ললিতাকে বিবাহ করিতে নিবৃত্ত না হয় তবে একটা কথা সে যেন চিন্তা করিয়া দেখে, ললিতার ফুসফুস দুর্বল, উক্তিারেরা যক্ষ্মার সম্ভাবনা আশঙ্কা করেন । বিনয় এরূপ চিঠি পাইয়া হতবুদ্ধি হইয়া গেল। এমনতরো কথার যে মিথ্যা করিয়াও সৃষ্টি হইতে *ীরে বিনয় কখনো তাহা মনে করে নাই। কারণ, সমাজের বাধায় ললিতার সঙ্গে বিনয়ের বিবাহ যে কোনোক্রমে সম্ভব হইতে পারে না ইহা তো কাহারও কাছে অগোচর নাই। এইজন্যই তো ললিতার প্রতি তাহার হৃদয়ের অনুরাগকে এতদিন সে অপরাধ বলিয়াই গণ্য করিয়া আসিতেছিল। কিন্তু শ্ৰীমনতরো চিঠি যখন তাহার হাতে আসিয়া পৌঁছিয়াছে তখন সমাজের মধ্যে এ সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ *ক্তর আলোচনা হইয়া গিয়াছে। ইহাতে সমাজের লোকের কাছে ললিতা যে কিরূপ অপমানিত *ইতেছে তাহা চিন্তা করিয়া তাহার মন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল। তাহার নামের সঙ্গে ললিতার নাম *ািড়ত হইয়া প্রকাশ্যভাবে লোকের মুখে সঞ্চরণ করিতেছে ইহাতে সে অত্যন্ত লজ্জিত ও সংকুচিত দিতেছে। মনে হইতে লাগিল, তাহার দৃষ্টিমাত্রও ললিতা আর কোনােদিন সহা করিতে পরিবে না। হীয় রে, মানবহৃদয়! এই অত্যন্ত ধিক্কারের মধ্যেও বিনয়ের চিত্তের মধ্যে একটি নিবিড় গভীর সূক্ষ্ম * তীব্র আনন্দ এক প্রান্ত হইতে আর-এক প্রান্তে সঞ্চরণ করিতেছিল, তাহাকে থামাইয়া রাখা