পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(፩\ኃbr রবীন্দ্র-রচনাবলী আমি এইখানেই রহিয়া গেলাম।” পরেশ যখন কোথাও কোনো আড়াল রাখিতে দিলেন না। তখন বিনয় বলিয়া উঠিল, “আমি যে, কর্তব্যের অনুরোধে একটা কষ্ট স্বীকার করতে যাচ্ছি এমন কথা মনেও করবেন না। আপনারা যদি সম্মতি দেন তবে আমার পক্ষে এমন সৌভাগ্য। আর-কিছুই হতে পারে না— কেবল আমার ভয় হয় পাছে--" সত্যপ্রিয় পরেশবাবু অসংকোচে কহিলেন, “তুমি যা ভয় করছি তার কোনো হেতু নেই ; আমি সুচরিতার কাছ থেকে শুনেছি। ললিতার মন তোমার প্রতি বিমুখ নয়।” বিনয়ের মনের মধ্যে একটা আনন্দের বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল। ললিতার মনের একটি গৃঢ় কথা সুচরিতার কাছে ব্যক্তি হইয়াছে। কবে ব্যক্তি হইল, কেমন করিয়া ব্যক্ত হইল ? দুই সখীর কাছে এই-যে আভাসে অনুমানে একটা জানাজানি হইয়াছে ইহার সুতীব্র রহস্যময় সুখ বিনয়কে যেন বিদ্ধ করিতে ब्लळ्नि । বিনয় বলিয়া উঠিল, “আমাকে যদি আপনারা যোগ্য মনে করেন তবে তার চেয়ে আনন্দের কথা আমার পক্ষে আর-কিছুই হতে পারে না ।” পরেশবাবু কহিলেন, “তুমি একটু অপেক্ষা করে । আমি একবার উপর থেকে আসি ৷” তিনি বরদাসুন্দরীর মত লইতে গেলেন । বরদাসুন্দরী কহিলেন, “বিনয়কে তো দীক্ষা নিতে হবে ।” পরেশবাবু কহিলেন, “তা নিতে হবে বৈকি ?” বরদাসুন্দরী কহিলেন, “ সেটা আগে ঠিক করে । বিনয়কে এইখানেই ডাকাও-না।” বিনয় উপরে আসিলে বরদাসুন্দরী কহিলেন, “তা হলে দীক্ষার দিন তো একটা ঠিক করতে হয় ।” বরদাসুন্দরী কহিলেন, “দরকার নেই! বল কী ! নইলে ব্ৰাহ্মসমাজে তোমার বিবাহ হবে কী করে ?” বিনয় চুপ করিয়া মাথা হেঁট করিয়া বসিয়া রহিল। বিনয় তাহার ঘরে বিবাহ করিতে সম্মত হইয়াছে শুনিয়াই পরেশবাবু ধরিয়া লইয়াছিলেন যে, সে দীক্ষা গ্ৰহণ করিয়া ব্ৰাহ্মসমাজে প্রবেশ করিবে । বিনয় কহিল, “ব্ৰাহ্মসমাজের ধর্মমতের প্রতি আমার তো শ্ৰদ্ধা আছে এবং এপর্যন্ত আমার ব্যবহারেও তার অন্যথাচরণ হয় নি। তবে কি বিশেষভাবে দীক্ষা নেওয়ার দরকার আছে ?" বরদাসুন্দরী কহিলেন, “যদি মতেই মিল থাকে। তবে দীক্ষা নিতেই বা ক্ষতি কী ?” বিনয় কহিল, “আমি যে হিন্দুসমাজের কেউ নই। এ কথা বলা আমার পক্ষে অসম্ভব ।” বরদাসুন্দরী কহিলেন, “তা হলে এ কথা নিয়ে আলোচনা করাই আপনার অন্যায় হয়েছে। আপনি কি আমাদের উপকার করবার জন্যে দয়া করে আমার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন ?” -- মতান্ত আছন্ত পাইল : বলি তার প্রস্তািট ইংলে গঙ্গে সন্তই আপনােক ইয় কিছুকাল হইল সিভিল বিবাহের আইন পাস হইয়া গেছে। সে সময়ে গোরা ও বিনয় কাগজে ঐ আইনের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে আলোচনা করিয়াছে । আজ সেই সিভিল বিবাহ স্বীকার করিয়া বিনয় নিজেকে “হিন্দু নয় বলিয়া ঘোষণা করিবে এও তো বড়ো শক্ত কথা । বিনয় হিন্দুসমাজে থাকিয়া ললিতাকে বিবাহ করিবে এ প্রস্তাব পরেশ মনের মধ্যে গ্ৰহণ করিতে পারিলেন না । দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বিনয় উঠিয়া দাড়াইল এবং উভয়কে নমস্কার করিয়া কহিল, “আমাকে মাপ করবেন, আমি আর অপরাধ বাড়াব না ।” r বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। সিঁড়ির কাছে আসিয়া দেখিল সম্মুখের বারান্দায় এক কোণে একটি ছােটাে ডেস্ক লইয়া ললিত একলা বসিয়া চিঠি লিখিতেছে। পায়ের শব্দে চােখ তুলিয়া ললিতা বিনয়ের মুখের দিকে চাহিল। সেই তাহার ক্ষণকালের দৃষ্টিটুকু বিনয়ের সমস্ত চিত্তকে এক মুহুর্তে মথিত করিয়া তুলিল। বিনয়ের সঙ্গে তো ললিতার নূতন পরিচয় নয়- কতবার সে তাহার মুখের