পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা Qやぬ দিকে চােখ তুলিয়ছে, কিন্তু আজ তাহার দৃষ্টির মধ্যে কী রহস্য প্রকাশ হইল ? সুচরিতা ললিতার একটি মনের কথা জানিয়ছে- সেই মনের কথাটি আজ ললিতার কালো চোখের পল্লবের ছায়ায় করুণায় ভরিয়া উঠিয়া একখানি সজল স্নিগ্ধ মেঘের মতো বিনয়ের চোখে দেখা দিল । বিনয়েরও এক মুহুর্তের চাহনিতে তাহার হৃদয়ের বেদনা বিদ্যুতের মতো ছুটিয়া গেল ; সে ললিতাকে নমস্কার করিয়া বিনা সম্ভাষণে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া চলিয়া গেল । Ꮚ Ꮼ গোরা জেল হইতে বাহির হইয়াই দেখিল পরেশবাবু এবং বিনয় দ্বারের বাহিরে তাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছেন । এক মাস কিছু দীর্ঘকাল নহে। এক মাসের চেয়ে বেশিদিন গোরা আত্মীয়বন্ধুদের নিকট হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া ভ্ৰমণ করিয়াছে, কিন্তু জেলের এক মাস বিচ্ছেদ হইতে বাহির হইয়াই সে যখন পরেশ ও বিনয়কে দেখিল তখন তাহার মনে হইল যেন পুরাতন বান্ধবদের পরিচিত সংসারে সে পুনর্জন্ম লাভ করিল। সেই রাজপথে খোলা আকাশের নীচে প্ৰভাতের আলোকে পরেশের শান্ত স্নেহপূর্ণ স্বভাবসীেমা মুখ দেখিয়া সে যেমন ভক্তির আনন্দে তাহার পায়ের ধূলা লইল, এমন আর কোনোদিন করে নাই। পরেশ তাহার সঙ্গে কোলাকুলি করিলেন । বিনয়ের হাত ধরিয়া গোরা হাসিয়া কহিল, “বিনয়, ইস্কুল থেকে আরম্ভ করে একসঙ্গেই তোমার সঙ্গে সমস্ত শিক্ষা লাভ করে এসেছি, কিন্তু এই বিদ্যালয়টাতে তোমার চেয়ে ফাকি দিয়ে এগিয়ে নিয়েছি ।” বিনয় হাসিতেও পারিল না, কোনো কথাও বলিতে পারিল না। জেলখানার দুঃখরহস্যের ভিতর দিয়া তাহার বন্ধু তাহার কাছে বন্ধুর চেয়ে আরো যেন অনেক বড়ো হইয়া বাহির হইয়াছে। গভীর সম্রামে সে চুপ করিয়া রহিল। গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “মা কেমন আছেন ?” বিনয় কহিল, “মা ভালোই আছেন ৷” পরেশবাবু কহিলেন, “এসো বাবা, তোমার জন্যে গাড়ি অপেক্ষা করে আছে।” তিনজনে যখন গাড়িতে উঠিতে যাইবেন এমন সময় হাঁপাইতে ইস্পাইতে অবিনাশ আসিয়া উপস্থিত । তাহার পিছনে ছেলের দল । অবিনাশকে দেখিয়াই গোরা তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠিয়া পড়বার উপক্ৰম করিল, কিন্তু তৎপূর্বেই সে আসিয়া পথরোধ করিয়া কহিল, “ গৌরমোহনবাবু, একটু দাঁড়ান ।” বলিতে বলিতেই ছেলেরা চীৎকার-শব্দে গান ধরিল দুখনিশীথিনী হল আজি ভোর । কাটিল কাটিল অধীনতা ডোর । গোরার মুখ লাল হইয়া উঠিল ; সে তাহার বীজস্বরে গর্জন করিয়া কহিল, “চুপ করো।” ছেলেরা বিস্মিত হইয়া চুপ করিল। গোরা কহিল, “অবিনাশ, এ-সমস্ত ব্যাপার কী ?” অবিনাশ তাহার শালের ভিতর হইতে কলাপাতায় মোড়া একটা কুন্দ ফুলের মোটা গোড়ে মালা বাহির করিল এবং তাহার অনুবতী একটি অল্পবয়স্ক ছেলে একখানি সোনার জলে ছাপানো কাগজ হইতে মিহি সুরে দম-দেওয়া আর্গিনের মতো দ্রুতবেগে কারামুক্তির অভিনন্দন পড়িয়া যাইতে আরম্ভ করিল। অবিনাশের মালা সবলে প্রত্যাখ্যান করিয়া গোরা অবরুদ্ধ ক্রোধের কণ্ঠে কহিল, “এখন বুঝি তোমাদের অভিনয় শুরু হল ? আজ রাস্তার ধারে আমাকে তোমাদের যাত্রার দলে সঙ সাজাবার জন্যে বুঝি এই এক মাস ধরে মহলা দিচ্ছিলে ?” অনেক দিন হইতে অবিনাশ এই প্ল্যান করিয়াছিল- সে ভাবিয়াছিল, ভারি একটা তাক লাগাইয়া দিবে। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি তখন এরূপ উপদ্রব প্রচলিত ছিল না । অবিনাশ বিনয়কেও