পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(ፅዓዪ። রবীন্দ্র-রচনাবলী কেবল দুটি অধিষ্ঠাত্রী দেবতার মুখ দেখিতে পাইত, সূর্য চন্দ্র তারার আলোক বিশেষ করিয়া তাঁহাদেরই মুখের উপর পািড়ত, স্নিগ্ধ নীলিমামণ্ডিত আকাশ তাঁহাদেরই মুখকে বেষ্টন করিয়া থাকিত— একটি মুখ সুমঙ্গল্পৰ্কত মাতার বৃদ্ধিতে উদ্ভাসিত আর-একটি নম্র সুন্দর মুখের সঙ্গে তাহার নূতন জেলের নিরানন্দ সংকীর্ণতার মধ্যে গোরা এই মুখের স্মৃতির সঙ্গে বিরোধ করিতে পারে নাই। এই ধ্যানের পুলকিটুকু তাহার জেলখানার মধ্যে একটি গভীরতর মুক্তিকে আনিয়া দিত। জেলখানার কঠিন বন্ধন তাহার কাছে যেন ছায়াময় মিথ্যা স্বপ্নের মতো হইয়া যাইত। স্পাদিত হৃদয়ের অতীন্দ্ৰিয় তরঙ্গগুলি জেলের সমস্ত প্রাচীর অবাধে ভেদ করিয়া আকাশে মিশিয়া সেখানকার পুষ্পপল্পবে হিল্লোলিত এবং সংসারকর্মক্ষেত্রে লীলায়িত হইতে থাকিত । গোরা মনে করিয়াছিল, কল্পনামূর্তিকে ভয় করিবার কোনো কারণ নাই। এইজন্য এক মাস কাল ইহাকে একেবারেই সে পথ ছাড়িয়া দিয়াছিল। গোরা জানিত, ভয় করিবার বিষয় কেবলমাত্র বাস্তব পদাৰ্থ । জেল হইতে বাহির হইবামাত্র গোরা যখন পরেশবাবুকে দেখিল তখন তাহার মন আনন্দে উচ্ছসিত হইয়া উঠিয়ছিল। সে যে কেবল পরেশবাবুকে দেখার আনন্দ তাহা নহে ; তাহার সঙ্গে গোরার এই কয়দিনের সঙ্গিনী কল্পনাও যে কতটা নিজের মায়া মিশ্ৰিত করিয়াছিল তাহা প্রথমটা গোরা বুঝিতে পারে নাই। কিন্তু ক্রমেই বুঝিল । স্টীমারে আসিতে আসিতে সে স্পষ্টই অনুভব করিল, পরেশবাবু যে তাহাকে আকর্ষণ করিতেছেন সে কেবল তাহার নিজগুণে নহে। এতদিন পরে গোরা আবার কোমর বাধিল । বলিল, “হার মানিব না । স্টীমারে বসিয়া বসিয়া, སྒྱུ་ ༦༩ ལོའི༦༠ কোনোপ্রকার সূক্ষ্ম বন্ধনে সে নিজের মনকে বধিতে দিবে না, এই সংকল্প এমন সময় বিনয়ের সঙ্গে তাহার তর্ক বধিয়া গেল। বিচ্ছেদের পর বন্ধুর সঙ্গে এই প্রথম মিলনেই তর্ক এমন প্রবল হইত না । কিন্তু আজ এই তর্কের মধ্যে তাহার নিজের সঙ্গেও তর্ক ছিল । এই তর্ক উপলক্ষে নিজের প্রতিষ্ঠভূমিকে গােরা নিজের কাছেও স্পষ্ট করিয়া লইতেছিল। এইজনাই গােরা আজ এত বিশেষ জোর দিয়া কথা বলিতেছিল— সেই জোরটুকুতে তার নিজেরই বিশেষ প্রয়োজন ছিল । যখন তাহার। আজিকার এই জোর বিনয়ের মনে বিরুদ্ধ জোরকেই উত্তেজিত করিয়া দিয়াছিল, যখন সে মনে মনে গোরার কথাকে কেবলই খণ্ডন করিতেছিল এবং গোরার নির্বন্ধকে অনায় গোড়ামি বলিয়া যখন তাহার সমস্ত চিত্ত বিদ্রোহী হইয়া উঠিতেছিল তখন বিনয় কল্পনাও করে নাই যে, গোরা নিজেকেই যদি আঘাত না করিত তবে আজ তাহার আঘাত হয়তো এত প্রবল হইত না | বিনয়ের সঙ্গে তর্কের পর গোরা ঠিক করিল, যুদ্ধক্ষেত্রের বাহিরে গেলে চলিবে না। আমি যদি নিজের প্রাণের ভয়ে বিনয়কে ফেলিয়া যাই, তবে বিনয় রক্ষা পাইবে না । (8 গোরার মন তখন ভাবে আবিষ্ট ছিল— সুচরিতাকে সে তখন একটি ব্যক্তিবিশেষ বলিয়া দেখিতেছিল না, তাহাকে একটি ভােব বলিয়া দেখিতেছিল। ভারতের নারী প্রকৃতি সুচরিতা-মূর্তিতে তাহার সম্মুখে প্রকাশিত হইল। ভারতের গৃহকে পুণ্যে সৌন্দর্যে ও প্রেমে মধুর ও পবিত্র করিবার জন্যই ইহার আবির্ভাব। যে লক্ষ্মী ভারতের শিশুকে মানুষ করেন, রোগীকে সেবা করেন, তাপীকে সান্তনা দেন, তুচ্ছকেও প্রেমের গীেরবে প্রতিষ্ঠা দান করেন, যিনি দুঃখে দুৰ্গতিতেও আমাদের দীনতমকেও ত্যাগ করেন নাই, অবজ্ঞা করেন নাই, যিনি আমাদের পূজাহাঁ হইয়াও আমাদের অযোগ্যতামকেও একমনে পূজা করিয়া আসিয়াছেন, যাহার নিপুণ সুন্দর হাত দুইখানি আমাদের কাজে উৎসর্গ করা এবং র্যাহার চিরসহিষ্ণু ক্ষমাপূর্ণ প্রেম অক্ষয় দানরূপে আমরা ঈশ্বরের কােছ হইতে লাভ করিয়াছি, সেই লক্ষ্মীরই একটি প্রকাশকে গোরা তাহার মাতার পার্থে প্রত্যক্ষ আসীন দেখিয়া গভীর