পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা (ሱዓዓ আনন্দে ভরিয়া উঠিল। তাহার মনে হইতে লাগিল, এই লক্ষ্মীর দিকে আমরা তাকাই নাই, ইহাকেই আমরা সকলের পিছনে ঠেলিয়া রাখিয়ছিলাম— আমাদের এমন দুৰ্গতির লক্ষণ আর কিছুই নাই। গোরার তখন মনে হইল- দেশ বলিতেই ইনি, সমস্ত ভারতের মর্মস্থানে প্ৰাণের নিকেতনে শতদল পদ্মের উপর ইনি বসিয়া আছেন, আমরাই ইহার সেবক । দেশের দুৰ্গতিতে ইহারই অবমাননা, সেই অবমাননায় উদাসীন আছি বলিয়াই আমাদের পৌরুষ আজ লজ্জিত । গোরা নিজের মনে নিজে আশ্চর্য হইয়া গেছে। যতদিন ভারতবর্ষের নারী তাহার অনুভবগোচর ছিল না ততদিন ভারতবর্ষকে সে যে কিরূপ অসম্পূৰ্ণ করিয়া উপলব্ধি করিতেছিল। ইতিপূর্বে তাহা সে জানিতই না । গোরার কাছে নারী যখন অত্যন্ত ছায়াময় ছিল তখন দেশ সম্বন্ধে তাহার যে কর্তব্যবোধ ছিল তাহাতে কী একটা অভাব ছিল। যেন শক্তি ছিল, কিন্তু তাহাতে প্ৰাণ ছিল না। যেন পেশী ছিল, কিন্তু স্নায়ু ছিল না। গোরা এক মুহূর্তেই বুঝিতে পারিল যে, নারীকে যতই আমরা দূর করিয়া ক্ষুদ্র করিয়া জানিয়াছি আমাদের পৌরুষও ততই শীর্ণ হইয়া মরিয়াছে। তাই গোরা যখন সুচরিতাকে কহিল “আপনি এসেছেন", তখন সেটা কেবল একটা প্রচলিত শিষ্টসম্ভাষণরূপে তাহার মুখ হইতে বাহির হয় নাই— তাহার জীবনে একটি নূতনলব্ধ আনন্দ ও বিস্ময় এই অভিবাদনের মধ্যে পূর্ণ হইয়া ছিল। কারাবাসের কিছু কিছু চিহ্ন গোরার শরীরে ছিল। পূর্বের চেয়ে সে অনেকটা রোগ হইয়া গেছে। জেলের অন্নে তাহার অশ্রদ্ধা ও অরুচি থাকাতে এই এক মাস কাল সে প্রায় উপবাস করিয়া ছিল । তাহার উজ্জ্বল শুভ্ৰ বৰ্ণও পূর্বের চেয়ে কিছু স্নান হইয়াছে। তাহার চুল অত্যন্ত ছোটাে করিয়া ছাটা হওয়াতে মুখের কৃশতা আরো বেশি করিয়া দেখা যাইতেছে। গোরার দেহের এই শীর্ণতাই সুচরিতার মনে বিশেষ করিয়া একটি বেদনাপূর্ণ সন্ত্ৰম জগাইয়া দিল । তাহার ইচ্ছা করিতে লাগিল প্ৰণাম করিয়া গোরার পায়ের ধূলা গ্ৰহণ করে। যে উদ্দীপ্ত আগুনের ধোওয়া এবং কাঠ আর দেখা যায় না গোরা সেই বিশুদ্ধ অগ্নিশিখাটির মতো তাহার কাছে প্ৰকাশ পাইল ! একটি করুণামিশ্রিত ভক্তির আবেগে সুচরিতার বুকের ভিতরটা কঁাপিতে লাগিল। তাহার মুখ দিয়া কোনো কথা বাহির হইল না । আনন্দময়ী কহিলেন, “আমার মেয়ে থাকলে যে কী সুখ হত এবার তা বুঝতে পেরেছি। গোরা ! তুই যে কটা দিন ছিলি নে, সুচরিতা যে আমাকে কত সত্ত্বনা দিয়েছে সে আর আমি কী বলব। আমার সঙ্গে তো ঐদের পূর্বে পরিচয় ছিল না। কিন্তু দুঃখের সময় পৃথিবীর অনেক বড়ো জিনিস, অনেক ভালো জিনিসের সঙ্গে পরিচয় ঘটে, দুঃখের এই একটি গীেরব এবার বুঝেছি। দুঃখের সান্তনা যে ঈশ্বর কোথায় কত জায়গায় রেখেছেন তা সব সময় জানতে পারি। নে বলেই আমরা কষ্ট পাই। মা, তুমি লজ্জা করছ, কিন্তু তুমি আমার দুঃসময়ে আমাকে কত সুখ দিয়েছ। সে কথা আমি তোমার সামনে না বলেই বা বাচি কী করে ।” গোরা গভীর কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টিতে সুচরিতার লজ্জিত মুখের দিকে একবার চাহিয়া আনন্দময়ীকে কহিল, “মা, তোমার দুঃখের দিনে উনি তোমার দুঃখের ভাগ নিতে এসেছিলেন, আবার আজ তোমার সুখের দিনেও তোমার সুখকে বাড়াবার জন্যে এসেছেন- হৃদয় যাদের বড়ো তাদেরই এইরকম অকারণ সৌহৃদ্য ।” বিনয় সুচরিতার সংকোচ দেখিয়া কহিল, “দিদি, চাের ধরা পড়ে গেলে চতুর্দিক থেকে শাস্তি পায়। আজ তুমি এঁদের সকলের কাছেই ধরা পড়ে গেছ, তারই ফলভোগ করছ। এখন পালাবে কোথায় ? আমি তোমাকে অনেক দিন থেকেই চিনি, কিন্তু কারও কাছে কিছু ফাস করি নি, চুপ করে বসে আছি— মনে মনে জানি বেশিদিন কিছুই চাপা থাকে না।” আনন্দময়ী হাসিয়া কহিলেন, “তুমি চুপ করে আছ বৈকি। তুমি চুপ করে থাকবার ছেলে কিনা! ফুল ফুকুও তােমাদের চেলেছ সেইিদন ধরে তােমলে গুণান কের ওর আর অশািন্সতেই नीं ।”