পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(53. (፩brS অনিষ্টকর। সে কথাও বলিতে ছাড়েন না। আসল কথা, তিনি যেমন করিয়া সুচরিতাকে অত্যন্ত ঘিরিয়া লাইতে চান কিছুতেই তাহা পারিতেছেন না বলিয়া কখনো বা সুচরিতার সঙ্গীদের প্রতি, কখনো বা তাহার শিক্ষার প্রতি কেবলই দোষারোপ করিতেছেন । ললিতা ও বিনয়কে লইয়া বসিয়া থাকা যে হরিমোহিনীর পক্ষে সুখকর তাহা নহে, তথাপি তাহাদের উভয়ের প্রতি রাগ করিয়াই তিনি বসিয়া রহিলেন । তিনি বুঝিয়েছিলেন যে, বিনয় ও ললিতার মাঝখানে একটি রহস্যময় সম্বন্ধ ছিল । তাই তিনি মনে মনে কহিলেন, “তোমাদের সমাজে যেমন বিধিই থাক, আমার এ বাড়িতে এই সমস্ত নির্লজ মেলামেশা, এই সব খৃস্টানি কাণ্ড ঘটিতে দিব না।” এ দিকে ললিতার মনেও একটা বিরোধের ভােব কণ্টকিত হইয়া উঠিয়ছিল। কাল সুচরিতার সঙ্গে আনন্দময়ীর বাড়িতে যাইতে সেও সংকল্প করিয়াছিল, কিন্তু কিছুতেই যাইতে পারিল না। গোরার প্রতি ললিতার প্রচুর শ্রদ্ধা আছে, কিন্তু বিরুদ্ধতাও অত্যন্ত তীব্র । গোরা যে সর্বপ্রকারেই তাহার প্রতিকূল এ কথা সে কিছুতেই মন হইতে তাড়াইতে পারে না । এমন-কি, যেদিন গোরা কারামুক্ত হইয়াছে সেইদিন হইতে বিনয়ের প্রতিও তাহার মনোভাবের একটা পরিবর্তন ঘটিয়াছে। কয়েক দিন পূর্বেও, বিনয়ের প্রতি যে তাহার একটা জোর দখল আছে। এ কথা সে খুব স্পর্ধা করিয়াই মনে করিয়াছিল। কিন্তু গোরার প্রভাবকে বিনয় কোনোমতেই কাটাইয়া উঠিতে পরিবে না, ইহা কল্পনামাত্ৰ করিয়াই সে বিনয়ের বিরুদ্ধে কোমর বাধিয়া দাড়াইল । ললিতাকে ঘরে প্রবেশ করিতে দেখিবামাত্র বিনয়ের মনের মধ্যে একটা আন্দোলন প্রবল হইয়া উঠিল । ললিতা সম্বন্ধে বিনয় কোনোমতেই সহজ ভাব রক্ষা করিতে পারে না। যখন হইতে তাহাদের দুইজনের বিবাহ-সম্ভাবনার জনশ্রুতি সমাজে রাটিয়া গেছে তখন হইতে ললিতাকে দেখিবামাত্র বিনয়ের মন বৈদ্যুতচঞ্চল চুম্বকশলার মতো স্পন্দিত হইতে থাকে। ঘরে বিনয়কে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া সুচরিতার প্রতি ললিতার রাগ হইল । সে বুঝিল, অনিচ্ছুক বিনয়ের মনকে অনুকুল করিবার জন্যই সুচরিতা তাহাকে লইয়া উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছে এবং এই বাকাকে সোজা করিবার জন্যই ললিতাকে আজ ডাক পডিয়াছে। সে হরিমোহিনীর দিকে চাহিয়া কহিল, “দিদিকে বোলো, এখন আমি থাকতে পারছি নে । আর-এক সময় আমি আসব।” এই বলিয়া বিনয়ের প্রতি কটাক্ষপাত মাত্র না করিয়া দ্রুতবেগে সে চলিয়া গেল তখন বিনয়ের কাছে হরিমোহিনীর আর বসিয়া থাকা অনাবশ্যক হওয়াতে তিনিও গৃহকার্য উপলক্ষে উঠিয়া গেলেন । ললিতার এই চাপা আগুনের মতো মুখের ভাব বিনয়ের কাছে অপরিচিত ছিল না। কিন্তু অনেক দিন এমন চেহারা সেদেখে নাই । সেই- যে এক সময়ে বিনয়ের সম্বন্ধে ললিতা তাহার অগ্নিবাণ উদ্যত সেই পুরাতন বাণ অস্ত্রশালা হইতে আবার বাহির হইয়াছে। তাহাতে একটুও মরিচার চিহ্ন পড়ে নাই। রাগ সহ্য করা যায়, কিন্তু ঘূণা সহ্য করা বিনয়ের মতো লোকের পক্ষে বড়ো কঠিন। ললিতা একদিন তাহাকে গোরাগ্রহের উপগ্ৰহমাত্ৰ মনে করিয়া তাহার প্রতি কিরূপ তীব্র অবজ্ঞা অনুভব করিয়াছিল তাহা বিনয়ের মনে পড়িল । আজও বিনয়ের দ্বিধায় বিনয় ললিতার কাছে যে কাপুরুষ বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে, এই কল্পনায় তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিল। তাহার কর্তবাবুদ্ধির সংকোচকে ললিতা ভীরুতা বলিয়া মনে করিবে, অথচ এ সম্বন্ধে নিজের হইয়া দুটাে কথা বলিবারও সুযোগ তাহার ঘটিবে না, ইহা বিনয়ের কাছে অসহ্য বােধ হইল। বিনয়কে তর্ক করিবার অধিকার হইতে বঞ্চিত করিলে বিনয়ের পক্ষে গুরুতর শাস্তি হয়। কারণ, বিনয় জানে সে তর্ক করিতে পারে, কথা গুছাইয়া বলিতে এবং কোনো-একটা পক্ষ সমর্থন করিতে তাহার অসামান্য ক্ষমতা । কিন্তু ললিতা যখন তাহার সঙ্গে লড়াই করিয়াছে তখন তাহাকে কোনোদিন যুক্তি প্রয়োগ করিবার অবকাশ দেয় নাই, আজও সে অবকাশ তাহার ঘটিবে না । sh সেই খবরের কাগজখানা পড়িয়া ছিল। বিনয় চঞ্চলতার আক্ষেপে সেটা টানিয়া লইয়া হঠাৎ