পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

QbrS রবীন্দ্র-রচনাবলী দেখিল এক জায়গায় পেনসিলের দাগ দিয়া চিহ্নিত। পড়িল, এবং বুঝিল এই আলোচনা এবং নীতি-উপদেশ তাহাদের দুইজনকেই উপলক্ষ করিয়া। ললিতা তাহার সমাজের লোকের কাছে প্রতিদিন যে কিরূপ অপমানিত হইতেছে তাহা বিনয় স্পষ্ট বুঝিতে পারিল । অথচ এই অবমাননা হইতে বিনয় তাহাকে রক্ষা করিবার কোনাে চেষ্টা করিতেছে না, কেবল সমাজতত্ত্ব লইয়া সূক্ষ্ম তর্ক করিতে উদ্যত হইয়াছে, ইহাতে ললিতার মতো তেজস্বিনী রমণীর কাছে সে যে অবজ্ঞাভাজন হইবে তাহা বিনয়ের কাছে সমুচিত বলিয়াই বোধ হইল। সমাজকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিতে ললিতার যে কিরূপ সাহস তাহা স্মরণ করিয়া এবং এই দৃপ্ত নারীর সঙ্গে নিজের তুলনা করিয়া সে লজ্জা অনুভব করিতে লাগিল । স্নান সারিয়া এবং সতীশকে আহার করাইয়া ইস্কুলে পঠাইয়া সুচরিতা যখন বিনয়ের কাছে আসিল তখন বিনয় নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছে। সুচরিতা পূর্বপ্রসঙ্গ উত্থাপন করিল না। বিনয় অন্ন আহার করিতে বসিল, কিন্তু তৎপূর্বে গণ্ডুষ করিল না। হরিমোহিনী কহিলেন, “আচ্ছা বাছা, তুমি তো হিন্দুয়ানির কিছুই মান না- তা হলে তুমি ব্ৰাহ্ম श्लई दा (प्राय की छिल ?” বিনয় মনে মনে কিছু আহত হইয়া কহিল, “হিন্দুয়ানিকে যেদিন কেবল ছোওয়া-খাওয়ার নিরর্থক নিয়ম বলেই জানিব সেদিন ব্ৰাহ্ম বলো, খৃস্টান বলো, মুসলমান বলো, যা হয় একটা-কিছু হব । এখনো হিন্দুয়ানির উপর তত অশ্রদ্ধা হয় নি।” বিনয় যখন সুচরিতার বাডি হইতে বাহির হইল। তখন তাহার মন অত্যন্ত বিকল হইয়া ছিল। সে যেন চারি দিক হইতেই ধাক্কা খাইয়া একটা আশ্রয়হীন শূন্যের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছিল। গোরার পাশে সে আপনার পুরাতন স্থানটি অধিকার করিতে পারিতেছে না, ললিতাও তাঁহাকে দূরে ঠেলিয়া রাখিতেছে- এমন-কি, হরিমোহিনীর সঙ্গেও তাহার হৃদ্যতার সম্বন্ধ অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বিচ্ছিন্ন হইবার উপক্রম হইয়াছে ; এক সময় বরদাসুন্দরী তাহাকে আন্তরিক স্নেহ করিয়াছেন, পরেশবাবু এখনো তাহাকে স্নেহ করেন, কিন্তু মেহের পরিবর্তে সে তাহদের ঘরে এমন অশান্তি আনিয়াছে যে সেখানেও তাহার আজ আর স্থান নাই । যাহাদিগকে ভালোবাসে তাহদের শ্রদ্ধা ও আদরের জন্য বিনয় চিরদিন কাঙাল, নানাপ্রকারে তাহদের সৌহৃদ্য আকর্ষণ করিবার শক্তিও তাহার যথেষ্ট আছে । সেই বিনয় আজ অকস্মাৎ তাহার স্নেহপ্ৰীতির চিরাভ্যস্ত কক্ষপথ হইতে এমন করিয়া বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িল কেন, এই কথাই সে নিজের মনে চিন্তা করিতে লাগিল। এই-যে সুচরিতার বাড়ি হইতে বাহির হইল এখন কোথায় যাইবে তাহা ভাবিয়া পাইতেছে না। এক সময় ছিল যখন কোনো চিন্তা না করিয়া সহজেই সে গোরার বাড়ির পথে চলিয়া যাইত, কিন্তু আজ সেখানে যাওয়া তাহার পক্ষে পূর্বের ন্যায় তেমন স্বাভাবিক নহে ; যদি যায়। তবে গোরার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া তাহাকে চুপ করিয়া থাকিতে হইবে— সে নীরবতা অত্যন্ত দুঃসহ। এ দিকে পরেশবাবুর বাড়িও তাহার পক্ষে সুগম নহে। ‘কেন যে এমন একটা অস্বাভাবিক স্থানে আসিয়া পৌছিলাম ইহাই চিন্তা করিতে করিতে মাথা ঠোঁট করিয়া বিনয় ধীরপদে রাস্তা দিয়া চলিতে লাগিল। হেদুয়া পুষ্করিণীর কাছে আসিয়া সেখানে একটা গাছের তলায় সে বসিয়া পড়িল । এ পর্যন্ত তাহার জীবনে ছোটােবড়ো যে-কোনো সমস্যা আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করিয়া, তর্ক করিয়া, তাহার মীমাংসা করিয়া লইয়াছে। আজ সে পন্থা নাই, আজ তাহাকে একলাই ভাবিতে হইবে । বিনয়ের আত্মবিশ্লেষণশক্তির অভাব নাই। বাহিরের ঘটনার উপরেই সমস্ত দোষ চাপাইয়া নিজে নিস্কৃতি লওয়া তাহার পক্ষে সহজ নহে। তাই সে একলা বসিয়া বসিয়া নিজেকেই দায়িক করিল। বিনয় মনে মনে কহিল— ‘জিনিসটিও রাখিব মূল্যটিও দিব না। এমন চতুরতা পৃথিবীতে খাটে না । একটা-কিছু বাছিয়া লইতে গেলেই অন্যটাকে ত্যাগ করিতেই হয়। যে লোক কোনোটাকেই মন স্থির করিয়া ছাড়িতে পারে না, তাহারই আমার দশা হয়, সমস্তই তাহাকে খেদাইয়া দেয় ! পৃথিবীতে যাহারা নিজের জীবনের পথ জোরের সঙ্গে বাছিয়া লইতে পারিয়াছে তাহারাই নিশ্চিন্ত হইয়াছে। যে হতভাগা