পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(ሱbr8 রবীন্দ্র-রচনাবলী পাড়িয়াছিলেন যাহাতে ব্যক্তিগত জীবনের তুচ্ছ সুখ-দুঃখের ভারকে একেবারে হালকা করিয়া দিতে 93 পিতা ও কন্যার এই বিশ্রান্ধ আলোচনার দৃশ্যটি দেখিয়া মুহুর্তের জন্য বিনয়ের গতিরোধ হইয়া গেলা- সতীশ কী বলিতেছিল তাহা তাহার কানে গেল না। সতীশ তখন তাহাকে যুদ্ধবিদ্যা সম্বন্ধে একটা অত্যন্ত দুরূহ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়াছিল। এক দল বাঘকে অনেক দিন ধরিয়া শিক্ষা দিয়া স্বপক্ষের সৈন্যদলের প্রথম সারে রাখিয়া যুদ্ধ করিলে তাহাতে জয়ের সম্ভাবনা কিরূপ ইহাই তাহার প্রশ্ন ছিল । এতক্ষণ তাহাদের প্রশ্নোত্তর অবাধে চলিয়া আসিতেছিল, হঠাৎ এইবার বাধা পাইয়া সতীশ সুস্থ বলিয়া উঠিল, "ললিতাৰ্প, ললিতািদ, এই দেখে আমি ক্লিকুক বাস্ত হেরে 83 ן" বিনয় লজ্জায় ঘামিয়া উঠিল ; ঘরের মধ্যে এক মুহুর্তে ললিতা চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাড়াইলপরেশবাবু রাস্তার দিকে মুখ ফিরাইয়া দেখিলেন— সবসুদ্ধ একটা কাণ্ড হইয়া গেল । তখন বিনয় সতীশকে বিদায় করিয়া পরেশবাবুর বাড়িতে উঠিল । তাহার ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল ললিতা চলিয়া গেছে। তাহাকে সকলেই শান্তিভঙ্গকারী দসু্যর মতো দেখিতেছে এই মনে করিয়া সে সংকুচিত হইয়া চৌকিতে বসিল । শারীরিক স্বাস্থ্য ইত্যাদি সম্বন্ধে সাধারণ শিষ্টালাপ শেষ হইতেই বিনয় একেবারেই আরম্ভ করিল, “আমি যখন হিন্দুসমাজের আচার-বিচারকে শ্রদ্ধার সঙ্গে মানি নে এবং প্রতিদিনই তা লঙ্ঘন করে থাকি, তখন ব্ৰাহ্মসমাজে আশ্রয় গ্ৰহণ করাই আমার কর্তব্য বলে মনে করছি । আপনার কাছ থেকেই দীক্ষা গ্ৰহণ করি এই আমার বাসনা ।” এই বাসনা, এই সংকল্প আর পনেরো মিনিট পূর্বেও বিনয়ের মনে স্পষ্ট আকারে ছিল না। পরেশবাবু ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া কহিলেন, “ভালো করে সকল কথা চিন্তা করে দেখেছ তো ?” বিনয় কহিল, “এর মধ্যে আর তো কিছু চিন্তা করবার নেই, কেবল ন্যায়-অন্যায়টাই ভেবে দেখবার বিষয়। সেটা খুব সাদা কথা । আমরা যে শিক্ষা পেয়েছি তাতে কেবল আচার-বিচারকেই অলঙ্ঘনীয় ধর্ম বলে আমি কোনোমতেই অকপটচিত্তে মানতে পারি। নে । সেইজন্যেই আমার ব্যবহারে পদে পদে নানা অসংগতি প্ৰকাশ পায়, যারা শ্রদ্ধার সঙ্গে হিন্দুয়ানিকে আশ্রয় করে আছে তাদের সঙ্গে জড়িত থেকে আমি তাদের কেবল আঘাতই দিই। এটা যে আমার পক্ষে নিতান্ত অন্যায় হচ্ছে তাতে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। এমন স্থলে আর-কোনো কথা চিন্তা না করে এই অন্যায় পরিহার করবার জন্যেই আমাকে প্ৰস্তুত হতে হবে । নইলে নিজের প্রতি সম্মান রাখতে পারব না ।” পরেশবাবুকে বুঝাইবার জন্য এত কথার প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু এ-সব কথা নিজেকেই জোর দিবার জন্য। সে যে একটা ন্যায়-অন্যায়ের যুদ্ধের মধ্যেই পড়িয়া গেছে এবং এই যুদ্ধে সমস্ত পরিত্যাগ করিয়া ন্যায়ের পক্ষেই তাহাকে জয়ী হইতে হইবে, এই কথা বলিয়া তাহার বক্ষ প্রসারিত হইয়া উঠিল। মনুষ্যত্বের মর্যাদা তো রাখিতে হইবে । তো ?” বিনয় একটুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “আপনাকে সত্য কথা বলি, আগে মনে করতুম আমার বুঝি একটা-কিছু ধর্মবিশ্বাস আছে ; তা নিয়ে অনেক লোকের সঙ্গে অনেক ঝগড়াও করেছি, কিন্তু আজ আমি নিশ্চয় জেনেছি। ধর্মবিশ্বাস আমার জীবনের মধ্যে পরিণতি লাভ করে নি । এটুকু যে বুঝেছি সে আপনাকে দেখে। ধর্মে আমার জীবনের কোনো সত্য প্রয়োজন ঘটে নি এবং তার প্রতি আমার সত্য বিশ্বাস জন্মে নি বলেই আমি কল্পনা এবং যুক্তিকৌশল দিয়ে এতদিন আমাদের সমাজের প্রচলিত ধর্মকে নানাপ্রকার সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা-দ্বারা কেবলমাত্র তর্কনৈপুণ্যে পরিণত করেছি। কোন ধর্ম যে সত্য তা ভাববার আমার কোনো দরকারই হয় না ; যে ধর্মকে সত্য বললে আমার জিত হয়। আমি তাকেই সত্য