পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা Öbrዒ তাড়াতাড়ি কিছু কোরো না- শান্ত হয়ে স্থির হয়ে সকল কথা চিন্তা করে দেখাে। নিজের মন সম্পূর্ণ না বুঝে জীবনের এত বড়ো একটা ব্যাপারে প্রবৃত্ত হােয়ে না।” বরদাসুন্দরী তাহার স্বামীর প্রতি মনে মনে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, “গোড়ায় কেউ ভেবেচিন্তে কাজ করে না, অনৰ্থ বাধিয়ে বসে, তার পরে যখন একেবারে দম আটকে আসে তখন বলেন, বসে বসে ভাবো । তোমরা স্থির হয়ে বসে ভাবতে পাের, কিন্তু আমাদের যে প্ৰাণ বেরিয়ে গেল।” বিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে সুধীর রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। রীতিমত আহারে বসিয়া খাইবার পূর্বেই চাখিবার ইচ্ছা যেমন, সুধীরের সেইরূপ চঞ্চলত উপস্থিত হইয়াছে। তাহার ইচ্ছা এখনই বিনয়কে বন্ধুসমাজে ধরিয়া লইয়া গিয়া সুসংবাদ দিয়া আনন্দ-উৎসব আরম্ভ করিয়া দেয়, কিন্তু সুধীরের এই আনন্দ-উচ্ছাসের অভিঘাতে বিনয়ের মন আরো দমিয়া যাইতে লাগিল। সুধীর যখন প্রস্তাব করিল “বিনয়বাবু, আসুন-না। আমরা দুজনে মিলেই পানুবাবুর কাছে যাই”, তখন সে কথায় কৰ্ণপাত না করিয়া জোর করিয়া তাহার হাত ছাড়াইয়া বিনয় চলিয়া গেল । কোথায় চলিয়াছে। বিনয়কে দেখিয়াই অবিনাশ কহিল, “এই-যে বিনয়বাবু, বেশ হয়েছে। চলুন আমাদের সঙ্গে ।” বিনয় বিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যােচ্ছ ?” অবিনাশ কহিল, “কাশীপুরের বাগান ঠিক করতে যাচ্ছি। সেইখানে গৌরমোহনবাবুর প্রায়শ্চিত্তের সভা বসবে ।” বিনয় কহিল, “না, আমার এখন যাবার জো নেই ।” অবিনাশ কহিল, “সে কী কথা ! আপনারা কি বুঝতে পারছেন এটা কত বড়ো একটা ব্যাপার হচ্ছে ! নইলে গৌরমোহনবাবু কি এমন একটা অনাবশ্যক প্রস্তাব করতেন ? এখনকার দিনে হিন্দুসমাজকে নিজের জোর প্রকাশ করতে হবে । এই গৌরমোহনবাবুর প্রায়শ্চিত্তে দেশের লোকের মনে কি একটা কম আন্দোলন হবে । আমরা দেশ বিদেশ থেকে বড়ো বড়ো ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিত সবাইকে নিমন্ত্রণ করে আনব । এতে সমস্ত হিন্দুসমাজের উপরে খুব একটা কাজ হবে । লোকে বুঝতে পারবে এখনো আমরা বেঁচে আছি । বুঝতে পারবে হিন্দুসমাজ মরবার নয়।” অবিনাশের আকর্ষণ এড়াইয়া বিনয় চলিয়া গেল । (፩ Aሪ হারানবাবুকে যখন বরদাসুন্দরী ডাকিয়া সকল কথা বললেন তখন তিনি কিছুক্ষণ গভীর হইয়া বসিয়া রহিলেন এবং কহিলেন, “এ সম্বন্ধে একবার ললিতার সঙ্গে আলোচনা করে দেখা কর্তব্য ।” ললিতা আসিলে হারানবাবু তাহার গভীর্যের মাত্রা শেষ সপ্তক পর্যন্ত চড়াইয়া কহিলেন, “দেখো ললিতা, তোমার জীবনে খুব একটা দায়িত্বের সময় এসে উপস্থিত হয়েছে। এক দিকে তোমার ধর্ম, আর-এক দিকে তোমার প্রবৃত্তি, এর মধ্যে তোমাকে পথ নির্বাচন করে নিতে হবে।” এই বলিয়া একটু থামিয়া হারানবাবু ললিতার মুখের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করিলেন। হারানবাবু জানিতেন তাহার এই ন্যায়াগ্নিদীপ্ত দৃষ্টির সম্মুখে ভীরুতা কম্পিত হয়, কপটতা ভস্মীভূত হইয়া যায়— তাহার এই তেজোময় আধ্যাত্মিক দৃষ্টি ব্ৰাহ্মসমাজের একটি মূল্যবান সম্পত্তি । ললিতা কোনো কথা বলিল না, চুপ করিয়া রহিল। হারানবাবু কহিলেন, “তুমি বােধ হয় শুনেছ, তোমার অবস্থার প্রতি দৃষ্টি করে অথবা যে কারণেই হােক বিনয়বাবু অবশেষে আমাদের সমাজে দীক্ষা নিতে রাজি হয়েছেন।” ললিতা এ সংবাদ পূর্বে শুনে নাই, শুনিয়া তাহার মনে কী ভাব হইল তাহাও প্রকাশ করিল না ; তাহার দুই চক্ষু দীপ্ত হইয়া উঠিল— সে পাথরের মূর্তির মতাে স্থির হইয়া বসিয়া রহিল। Wor