পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ s)○ রবীন্দ্র-রচনাবলী সম্মুখে প্রবল হৃদয়বেগ প্রকাশ করিতে ললিতা লজ্জা করিতেছে। ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন পরদিন সকালবেলায় চিঠিখানি লইয়া ব্ৰাহ্মসমাজে যাইবার সময় দেখিলেন সে চিঠি কে টুকটু (፩ ዓ অপরাহুে সুচরিতা পরেশবাবুর কাছে। যাইবে বলিয়া প্রস্তুত হইতেছিল এমন সময় বেহারা আসি খবর দিল। একজন বাবু আসিয়াছেন । “কে বাবু ? বিনয়বাবু ?” বেহার কহিল, “না, খুব গৌরবর্ণ, লম্বা একটি বাবু।” সুচরিতা চমকিয়া উঠিয়া কহিল, “বাবুকে উপরের ঘরে এনে বসাও।” আজ সুচরিতা কী কাপড় পরিয়াছে ও কেমন করিয়া পরিয়াছে এতক্ষণ তাহা চিন্তাও করে নাই এখন আয়নার সম্মুখে দাড়াইয়া কাপড়খানা কিছুতেই তাহার পছন্দ হইল না । তখন বদলাইবার সম ছিল না। কম্পিত হস্তে কাপড়ের আঁচলে, চুলে, একটু-আধটু পারিপটা সাধন করিয়া স্পন্দিত হৃৎপি লইয়া সুচরিতা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। তাহার টেবিলের উপর গোরার রচনাবলী পড়িয়া ছিল ? কথা তাহার মনেই ছিল না । ঠিক সেই টেবিলের সম্মুখেই চৌকিতে গোরা বসিয়া আছে। বইগু নির্লজ্জভাবে ঠিক গোরার চোখের উপরে পড়িয়া আছে-- সেগুলি ঢাকা দিবার বা সরাইবার কো উপায়মাত্ৰ নাই । “মাসিম আপনার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে অনেক দিন থেকে ব্যস্ত হয়ে রয়েছেন, তাকে খবর দি গে” বলিয়া সুচরিতা ঘরে প্রবেশ করিয়াই চলিয়া গেল— সে একলা গোরার সঙ্গে আলাপ করিব মতো জোর পাইল না । কিছুক্ষণ পরে সুচরিতা হরিমোহিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিল । কিছুকাল হইতে হরিমোহি বিনয়ের কাছ হইতে গোরার মত বিশ্বাস ও নিষ্ঠা এবং তাহার জীবনের কথা শুনিয়া আসিতেছেন প্রায় মাঝে মাঝে তাহার অনুরোধে সুচরিতা মধ্যাহ্নে তাহাকে গোরার লেখা পড়িয়া শুনাইয়াছে । যদি সে-সব লেখা তিনি যে সমস্তই ঠিক বুঝিতে পারিতেন তাহা নহে এবং তাঁহাতে তাহার নিদ্ৰাকর্ষণে সুবিধা করিয়া দিত। তবু এটুকু মোটামুটি বুঝিতে পারিতেন যে, শাস্ত্র ও লোকাচারের পক্ষ লইয়া গো এখনকার কালের আচারহীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করিতেছে । আধুনিক ইংরেজি-শেখা ছেলের পা ইহা অপেক্ষা আশ্চর্য এরং ইহা অপেক্ষা গুণের কথা আর কী হইতে পারে । ব্ৰাহ্মপরিবারের মা প্রথম যখন বিনয়কে দেখিয়াছিলেন তখন বিনয়ই তাহাকে যথেষ্ট তৃপ্তিদান করিয়াছিল । কিন্তু ক্ৰ সেটুকু অভ্যাস হইয়া যাওয়ার পর নিজের বাড়িতে যখন তিনি বিনয়কে দেখিতে লাগিলেন তা তাহার আচারের ছিদ্রগুলিই তাহাকে বেশি করিয়া বাজিতে লাগিল । বিনয়ের উপর তিনি অনেক নির্ভর স্থাপন করিয়াছিলেন বলিয়াই, তাহার প্রতি ধিক্কার তাহার প্রতিদিন বাডিয়া উঠিতেছে সেইজন্যই অত্যন্ত উৎসুকচিত্তে তিনি গোরার প্রতীক্ষা করিতেছিলেন । গোরার দিকে নেত্রপাত করিয়াই হরিমোহিনী একেবারে আশ্চর্য হইয়া গেলেন । এই তো ব্ৰাহ্ম বটে ! যেন একেবারে হােমের আগুন । যেন শুভ্রকায় মহাদেব । তাহার মনে এমন একটি ভর্তি সঞ্চার হইল যে, গোরা যখন তাহাকে প্ৰণাম করিল তখন সে প্ৰণাম গ্ৰহণ করিতে হরিমোহিনী কু{ি হইয়া উঠিলেন । হরিমোহিনী কহিলেন, “তোমার কথা অনেক শুনেছি বাবা ! তুমিই গীের ? গীেরই বটে ! ঐকীর্তনের গান শুনেছি চাদের অমিয়া-সনে চন্দন বাটিয়া গো কে মাজিল গোরার দেহখানি আঙ্গ তাই চক্ষে দেখলুম। কোন প্ৰাণে তোমাকে জেলে দিয়েছিল। আমি সেই কথাই ভাবি