পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(ò) NR রবীন্দ্র-রচনাবলী গােরা কহিল, “মানুষকে মারতে গেলে সে ঠেকাতে যায় কেন ? তার প্রাণ আছে বলে। পাথরই সকলরকম আঘাতে চুপ করে পড়ে থাকে।” সুচরিতা কহিল, “আমি যাকে ধর্ম বলে জ্ঞান করছি হিন্দু যদি তাকে আঘাত বলে গণ্য করে, তবে সে স্থলে আমাকে আপনি কী করতে বলেন ?” গোরা কহিল, “তখন আমি আপনাকে বলব যে, যেটাকে আপনি কর্তব্য মনে করছেন সেটা যখন হিন্দুজাতি বলে এতবড়ো একটি বিরাট সত্তার পক্ষে বেদনাকর আঘাত তখন আপনাকে খুব চিন্তা করে দেখতে হবে আপনার মধ্যে কোনো ভ্ৰম, কোনো অন্ধতা আছে কি না- আপনি সব দিক সকল রকম করে চিন্তা করে দেখেছেন কি না । দলের লোকের সংস্কারকে কেবলমাত্র অভ্যাস বা আলস্যা -বশত সত্য বলে ধরে নিয়ে এতবড়ো একটা উৎপাত করতে প্ৰবৃত্ত হওয়া ঠিক নয়। ইদুর যখন জাহাজের খোল কাটতে থাকে তখন ইদুরের সুবিধা ও প্রবৃত্তির হিসাব থেকেই সে কাজ করে, দেখে না। এতবড় একটা আশ্রয়ে ছিদ্র করলে তার যেটুকু সুবিধা তার চেয়ে সকলের কতবড়ো ক্ষতি । আপনাকেও তেমনি ভেবে দেখতে হবে আপনি কি কেবল আপনার দলটির কথা ভাবছেন, না সমস্ত মানুষের কথা ভাবছেন ? সমস্ত মানুষ বললে কতটা বোঝায় তা জানেন ? তার কতরকমের প্রকৃতি, কতরকমের প্রবৃত্তি, কতরকমের প্রয়োজন ? সব মানুষ এক পথে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই- কারও সামনে পাহাড়, কারও সামনে সমুদ্র, কারও সামনে প্রান্তর । অথচ কারও বসে থাকবার জো নেই, সকলকেই চলতে হবে । আপনি কেবল আপনার দলের শাসনটিকেই সকলের উপর খাটাতে চান ? চােখ বুজে মনে করতে চান, মানুষের মধ্যে কোনো বৈচিত্রই নেই, কেবল ব্ৰাহ্মসমাজের খাতায় নাম লেখাবার জন্যেই সকলে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছে ? যে-সকল দসুজাতি পৃথিবীর সমস্ত জাতিকেই যুদ্ধে জয় করে নিজের একচ্ছত্র রাজত্ব বিস্তার করাকেই পৃথিবীর একমাত্র কল্যাণ বলে কল্পনা করে, অন্যান জাতির বিশেষত্ব যে বিশ্বহিতের পক্ষে বহুমূল্য বিধান নিজের বলগর্বে তা যারা স্বীকার করে না এবং পৃথিবীতে কেবল দাসত্ব বিস্তার করে, তাদের সঙ্গে আপনাদের প্রভেদ কোনখানে ?” সুচরিতা ক্ষণকালের জন্য তর্কযুক্তি সমস্তই ভুলিয়া গেল। গোরার বজ্ৰগম্ভীর কণ্ঠস্বর একটি আশ্চর্য প্রবলতাদ্বারা তাহার সমস্ত অন্তঃকরণকে আন্দোলিত করিয়া তুলিল। গোরা যে কোনো-একটা বিষয় লইয়া তর্ক করিতেছে তাহ সুচার তার মনে রহিল না, তাহার কাছে কেবল এই সত্যটুকু জাৰ্ণাতে লাগিল যে, গোরা বলিতেছে । গোরা কহিল, “আপনাদের সমাজই ভারতের বিশ কোটি লোককে সৃষ্টি করে নি ; কোন পস্থা এই বিশ কোটি লোকের পক্ষে উপযোগী, কোন বিশ্বাস কোন আচার এদের সকলকে খাদ্য দেবে, শক্তি দেবে, তা বেঁধে দেবার ভার জোর করে নিজের উপর নিয়ে এতবড়ো ভারতবর্ষকে একেবারে একাকার সমতল করে দিতে চান কী বলে ? এই অসাধ্যসাধনে যতই বাধা পাচ্ছেন ততই দেশের উপর আপনাদের রাগ হচ্ছে, অশ্রদ্ধা হচ্ছে, ততই যাদের হিত করতে চান তাদের ঘূণা করে পর করে তুলছেন। অথচ যে ঈশ্বর মানুষকে বিচিত্র করে সৃষ্টি করেছেন এবং বিচিত্রই রাখতে চান তীকেই আপনারা পূজা করেন এই কথা কল্পনা করেন। যদি সত্যই আপনারা তাকে মানেন তবে তার বিধানকে আপনারা স্পষ্ট করে দেখতে পান না কেন, নিজের বুদ্ধির এবং দলের অহংকারে কেন এর তাৎপর্যটি গ্ৰহণ করছেন না ?” সুচরিতা কিছুমাত্র উত্তর দিবার চেষ্টা না করিয়া চুপ করিয়া গোরার কথা শুনিয়া যাইতেছে দেখিয়া গোরার মনে করুণার সঞ্চার হইল। সে একটুখানি থামিয়া গলা নামাইয়া কহিল, “আমার কথাগুলো আপনার কাছে হয়তো কঠোর শোনাচ্ছে, কিন্তু আমাকে একটা বিরুদ্ধপক্ষের মানুষ বলে মনে কোনো বিদ্রোহ রাখবেন না। আমি যদি আপনাকে বিরুদ্ধপক্ষ বলে মনে করতুম তা হলে কোনো কথাই বলতুম না। আপনার মনে যে একটি স্বাভাবিক উদার শক্তি আছে সেটা দলের মধ্যে সংকুচিত হর্দেষ্ট বলে আমি কষ্ট বোধ করছি।” সুচরিতার মুখ আরক্তিম হইল ; সে কহিল, “না না, আমার কথা। আপনি কিছু ভাববেন না। আপনি