পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VO8 রবীন্দ্র-রচনাবলী করো ঈশ্বরের সম্বন্ধে কোনো একটি শাস্ত্রের বাক্য স্মরণ করলে তোমার খুব ভক্তি হয় ; সেই বাক্যটি যে পাতায় লেখা আছে সেই পাতাটা মেপে, তার অক্ষর কয়টা গুনেই কি তুমি সেই বাক্যের মহত্ত্ব স্থির করবে ? ভাবের অসীমতা বিস্তৃতির অসীমতার চেয়ে যে ঢের বড়ো জিনিস। চন্দ্ৰসূৰ্যতারাখচিত অনন্ত আকাশের চেয়ে ঐ এতটুকু ঠাকুরটি যে তোমার মসির কাছে যথার্থ অসীম। পরিমাণগত অসীমকে তুমি অসীম বল, সেইজন্যেই চােখ বুজে তোমাকে অসীমের কথা ভাবতে হয়, জানি নে তাতে কোনাে ফল পাও কি না। কিন্তু হৃদয়ের অসীমকে চোখ মেলে এতটুকু পদার্থের মধ্যেও পাওয়া যায়। তাই যদি না পাওয়া যেত। তবে তোমার মসির যখন সংসারের সমস্ত সুখ নষ্ট হয়ে গেল তখন তিনি ঐ ঠাকুরটিকে এমন করে আঁকড়ে ধরতে পারতেন কি ? হৃদয়ের অত বড়ো শূন্যতা কি খেলাচ্ছলে এক টুকরো পাথর দিয়ে ভরানাে যায় ? ভাবের অসীমতা না হলে মানুষের হৃদয়ের ফাঁকা ভরে না।” এমন সকল সূক্ষ্ম তর্কের উত্তর দেওয়া সুচরিতার অসাধ, অথচ ইহাকে সত্য বলিয়া মানিয়া যাওয়াও তাহার পক্ষে একেবারে অসম্ভব। এইজন্য কেবল ভাষাহীন প্ৰতিকারহীন বেদন তাহার মনে বাজিতে থাকে | বিরুদ্ধপক্ষের সহিত তর্ক করিবার সময় গোরার মনে কোনােদিন এতটুকু দয়ার সঞ্চার হয় নাই। বরঞ্চ এ সম্বন্ধে শিকারি জন্তুর মতো তাহার মনে একটা কঠোর হিংস্রতা ছিল। কিন্তু সুচরিতার নিরুত্তর পরাভাবে আজ তাহার মন কেমন ব্যথিত হইতে লাগিল। সে কণ্ঠস্বরকে কোমল করিয়া কহিল, “তোমাদের ধর্মমতের বিরুদ্ধে আমি কোনো কথা বলতে চাই নে। আমার কথাটুকু কেবল এই, তুমি যাকে ঠাকুর বলে নিন্দা করছি সেই ঠাকুরটি যে কী তা শুধু চােখে দেখে জানাই যায় না ; তাতে যার মন স্থির হয়েছে, হৃদয় তৃপ্ত হয়েছে, যার চরিত্র আশ্রয় পেয়েছে, সেই জানে সে ঠাকুর মৃন্ময় কি চিন্ময়, সসীম কি অসীম। আমি তোমাকে বলছি, আমাদের দেশের কোনাে ভক্তই সসীমের পূজা করে না- সীমার মধ্যে সীমাকে হারিয়ে ফেলা ঐ তো তাদের ভক্তির আনন্দ ।” সুচরিতা কহিল, “কিন্তু সবাই তো ভক্ত নয়।” গোরা কহিল, “যে ভক্ত নয় সে কিসের পূজা করে তাতে কার কী আসে যায় ? ব্রাহ্মসমাজে যে লোক ভক্তিহীন সে কী করে ? তার সমস্ত পূজা অতলস্পর্শ শূন্যতার মধ্যে গিয়ে পড়ে। না, শূন্যতার চেয়ে ভয়ানক— দলাদলিই তার দেবতা, অহংকারই তার পুরোহিত। এই রক্তপিপাসু দেবতার পূজা তোমাদের সমাজে কি কখনো দেখ নি ?” এই কথার কোনো উত্তর না দিয়া সুচরিতা গোরাকে জিজ্ঞাসা করিল, “ধৰ্মসম্বন্ধে আপনি এই য-সব বলছেন এ কি আপনি নিজের অভিজ্ঞতার থেকে বলছেন ?” গোরা ঈষৎ হাসিয়া কহিল, অর্থাৎ, তুমি জানতে চাও, আমি কোনোদিনই ঈশ্বরকে চেয়েছি কি না | না, আমার মন ও দিকেই যায় নি।” সুচরিতার পক্ষে এ কথা খুশি হইবার কথা নহে, কিন্তু তবু তাহার মন যেন হীপ ছাড়িয়া বাঁচিল । এইখানে জোর করিয়া কোনো কথা বলিবার অধিকার যে গোরার নাই। ইহাতে সে একপ্রকার নিশ্চিন্ত হইল । গোরা কহিল, “কাউকে ধর্মশিক্ষা দিতে পারি এমন দাবি আমার নেই। কিন্তু আমাদের দেশের লোকের ভক্তিকে তোমরা যে উপহাস করবে এও আমি কোনােদিন সহ্য করতে পারব না। তুমি তোমার দেশের লোককে ডেকে বলছ— তোমরা মূঢ়, তোমরা পৌত্তলিক। আমি তাদের সবাইকে আহবান করে জানতে চাই— না, তোমরা মূঢ় নও, তোমরা পৌত্তলিক নও, তোমরা জ্ঞানী, তোমরা ভক্ত। আমাদের ধর্মতত্ত্বে যে মহত্ত্ব আছে, ভক্তিতত্ত্বে যে গভীরতা আছে, শ্রদ্ধাপ্রকাশের দ্বারা সেইখানেই আমার দেশের হৃদয়কে আমি জাগ্রত করতে চাই। যেখানে তার সম্পদ আছে সেইখানে তার অভিমানকে আমি উদ্যত করে তুলতে চাই। আমি তার মাথা হেঁট করে দেব না ; নিজের প্রতি তার ধিক্কার জন্মিয়ে নিজের সত্যের প্রতি তাকে অন্ধ করে তুলব না, এই আমার পণ । তোমার কাছেও আজ আমি এইজন্যেই এসেছি। তোমাকে দেখে অবধি একটি নূতন কথা দিনরাত্রি আমার মাথায়