পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা ما O ) ঘুরছে। এতদিন সে কথা আমি ভাবি নি। কেবলই আমার মনে হচ্ছে— কেবল পুরুষের দৃষ্টিতেই তো ভারতবর্ষ সম্পূর্ণ প্রত্যক্ষ হবেন না। আমাদের মেয়েদের চােখের সামনে যেদিন আবির্ভূত হবেন সেইদিনই তীর প্রকাশ পূর্ণ হবে। তোমার সঙ্গে একসঙ্গে একদৃষ্টিতে আমি আমার দেশকে সম্মুখে দেখব। এই একটি আকাঙক্ষা যেন আমাকে দগ্ধ করছে। আমার ভারতবর্ষের জন্য আমি পুরুষ তো কেবলমাত্র খেটে মরতে পারি— কিন্তু তুমি না হলে প্ৰদীপ জ্বেলে তাকে বরণ করবে কে ? ভারতবর্ষের সেবা সুন্দর হবে না, তুমি যদি তীর কাছ থেকে দূরে থাক ৷” হয়, কোথায় ছিল ভারতবর্ষ! কোন সুদূরে ছিল সুচরিতা ! কোথা হইতে আসিল ভারতবর্ষের এই সাধক, এই ভাবে-ভোলা তাপস ! সকলকে ঠেলিয়া কেন সে তাঁহারই পাশে আসিয়া দাড়াইল । সকলকে ছাড়িয়া কেন সে তাহাকেই আহবান করিল ! কোনো সংশয় করিল না, বাধা মানিল না । বলিল— ‘‘তোমাকে নহিলে চলিবে না, তোমাকে লইবার জন্য আসিয়াছি, তুমি নির্বাসিত হইয়া থাকিলে যজ্ঞ সম্পূর্ণ হইবে না।' সুচরিতার দুই চক্ষু দিয়া ঝর ঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল, কেন তাহা সে বুঝিতে পারিল না। গোরা সুচরিতার মুখের দিকে চাহিল। সেই দৃষ্টির সম্মুখে সুচরিতা তাহার অশ্রুবিগলিত দুই চক্ষু নত করিল না। চিন্তাবিহীন শিশিরমণ্ডিত ফুলের মতো তাহা নিতান্ত আত্মবিস্মৃতভাবে গােরার মুখের দিকে ফুটিয়া রহিল। সুচরিতার সেই সংকোচবিহীন সংশয়বিহীন অশ্রুধারাপ্লিাবিত দুই চক্ষুর সম্মুখে, ভূমিকম্পে পাথরের রাজপ্ৰসাদ যেমন টলে তেমনি করিয়া গোরার সমস্ত প্ৰকৃতি যেন টলিতে লাগিল। গোরা প্রাণপণ বলে আপনাকে সংবরণ করিয়া লইবার জন্য মুখ ফিরাইয়া জানালার বাহিরের দিকে চাহিল। তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। গলির রেখা সংকীর্ণ হইয়া যেখানে বড়ো রাস্তার পড়িয়াছে সেখানে খোলা আকাশে কালো পাথরের মতো অন্ধকারের উপর তারা দেখা যাইতেছে। সেই আকাশখণ্ড, সেই কাটি তারা গোরার মনকে আজ কোথায় বহন করিয়া লইয়া গেল— সংসারের সমস্ত দাবি হইতে, এই অভ্যস্ত পৃথিবীর প্রতিদিনের সুনির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি হইতে কত দূরে !! রাজ্যসাম্রাজ্যের কত উত্থানপতন, যুগযুগান্তরের কত প্রয়াস ও প্রার্থনাকে বহুদূরে অতিক্রম করিয়া ঐটুকু আকাশ এবং ঐ কাটি তারা সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত হইয়া অপেক্ষা করিয়া আছে ; অথচ, অতলস্পর্শ গভীরতার মধ্য হইতে এক হৃদয় যখন আর-এক হৃদয়কে আহবান করে তখন নিভৃত জগৎপ্রান্তের সেই বাক্যহীন ব্যাকুলতা যেন ঐ দূর আকাশ এবং দূর তারাকে স্পন্দিত করিতে থাকে। কর্মরত কলিকাতার পথে গাড়ি-ঘোড়া ও পথিকের চলাচল এই মুহূর্তে গোরার চক্ষে ছায়াছবির মতো বস্তুহীন হইয়া গেল— নগরের কোলাহল কিছুই তাহার কাছে আর পৌছিল না | নিজের হৃদয়ের দিকে চাহিয়া দেখিল- সেও ঐ আকাশের মতো নিস্তব্ধ, নিভৃত, অন্ধকার, এবং সেখানে জলে-ভরা দুইটি সরল সকরুণ চক্ষু নিমেষ হারাইয়া যেন হরিমোহিনীর কণ্ঠ শুনিয়া গোরা চমকিয়া উঠিয়া মুখ ফিরাইল । “বাবা, কিছু মিষ্টিমুখ করে যাও।” গােরা তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, “আজ কিন্তু নয়। আজ আমাকে মাপ করতে হবে— আমি এখনই যাচ্ছি।” বলিয়া গোরা আর-কোনো কথার অপেক্ষা না করিয়া দ্রুতবেগে বাহির হইয়া চলিয়া গেল । হরিমোহিনী বিস্মিত হইয়া সুচরিতার মুখের দিকে চাহিলেন । সুচরিতা ঘর হইতে বাহির হইয়া গৈল । হরিমোহিনী মাথা নাডিয়া ভাবিতে লাগিলেন– এ আবার কী কাণ্ড ! অনতিকাল পরেই পরেশবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সুচরিতার ঘরে সুচরিতাকে দেখিতে না পাইয়া হরিমোহিনীকে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “রাধারানী কোথায় ?” হরিমোহিনী বিরক্তির কণ্ঠে কহিলেন, “কী জানি, এতক্ষণ তো গীেরমোহনের সঙ্গে বসবার ঘরে আলাপ চলছিল, তার পরে এখন বোধ হয় ছাতে একলা পায়চারি হচ্ছে।”