পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা । との9 পরেশ কহিলেন, “জানি এতে একটা সংকট উপস্থিত হবে । কিন্তু ললিতার সঙ্গে বিনয়ের বিবাহে যখন দোষ কিছু নেই, এমন-কি, সেটা উচিত, তখন সমাজে যদি বাধে তবে সে বাধা মানা কর্তব্য নয় বলে আমার মন বলছে। মানুষকেই সমাজের খাতিরে সংকুচিত হয়ে থাকতে হবে এ কথা কখনোই ঠিক নয়- সমাজকেই মানুষের খাতিরে নিজেকে কেবলই প্রশস্ত করে তুলতে হবে। সেজন্যে যারা দুঃখ স্বীকার করতে রাজি আছে আমি তো তাদের নিন্দা করতে পারব না।” সুচরিতা কহিল, “বাবা, এতে তোমাকেই সব চেয়ে বেশি দুঃখ পেতে হবে।” পরেশ কহিলেন, “সে কথা ভাববার কথাই নয় ।” সুচরিতা জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, তুমি কি সম্মতি দিয়েছ ?” পরেশ কহিলেন, “না, এখনো দিইনি। কিন্তু দিতেই হবে । ললিতা যে পথে যাচ্ছে সে পথে আমি ছাড়া কে তাকে আশীৰ্বাদ করবে। আর ঈশ্বর ছাড়া কে তার সহায় আছেন ?” পরেশবাবু যখন চলিয়া গেলেন তখন সুচরিতা স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া রহিল। সে জানিত পরেশ ললিতাকে মনে মনে কত ভালোবাসেন, সেই ললিতা বাধা পথ ছাড়িয়া দিয়া এতবড়ো একটা অনির্দেশ্যের মধ্যে প্রবেশ করিতে চলিয়াছে, ইহাতে র্তাহার মন যে কত উদবিগ্ন তাহা তাহার বুঝিতে বাকি ছিল না- তৎসত্ত্বে এই বয়সে তিনি এমন একটা বিপ্লবে সহায়তা করিতে চলিয়াছেন, অথচ ইহার মধ্যে বিক্ষোভ কতই অল্প ! নিজের জোর তিনি কোথাও কিছুমাত্র প্রকাশ করেন নাই, কিন্তু তার মধ্যে কতবড়ো একটা জোর অনায়াসেই আত্মগোপন করিয়া আছে! পূর্বে হইলে পরেশের প্রকৃতির এই পরিচয় তাহার কাছে বিচিত্র বলিয়া ঠেকিত না, কেননা পরেশকে শিশুকাল হইতেই তো সে দেখিয়া আসিতেছে। কিন্তু আজই কিছুক্ষণ পূর্বেই নাকি সুচরিতার সমস্ত অন্তঃকরণ গোরার অভিঘাত সহ্য করিয়াছে, সেইজন্য এই দুই শ্রেণীর স্বভাবের সম্পূর্ণ পার্থক্য সে মনে মনে সুস্পষ্ট অনুভব না করিয়া থাকিতে পারিল না। গোরার কাছে তাহার নিজের ইচ্ছা কী প্রচণ্ড । এবং সেই ইচ্ছাকে সবেগে প্রয়োগ করিয়া সে অন্যকে কেমন করিয়া অভিভূত করিয়া ফেলে ! গোরার সহিত যে-কেহ যে-কোনো সম্বন্ধ স্বীকার করিবে গোরার ইচ্ছার কাছে তাহাকে নত হইতে হইবে । সুচরিতা আজ নত হইয়াছে এবং নত হইয়া আনন্দও পাইয়াছে, আপনাকে বিসর্জন করিয়া একটা বড়ো জিনিস পাইয়াছে বলিয়া অনুভব করিয়াছে, কিন্তু তবু আজ পরেশ যখন তাহার ঘরের দীপালোক হইতে ধীরপদে চিন্তানত মস্তকে বাহিরের অন্ধকারে চলিয়া গেলেন তখন যৌবনতেজোদীপ্ত গোরার সঙ্গে বিশেষভাবে তুলনা করিয়াই সুচরিতা অন্তরের ভক্তি-পুষ্পাঞ্জলি বিশেষ করিয়া পরেশের চরণে সমৰ্পণ করিল এবং কোলের উপর দুই করতল জুড়িয়া অনেকক্ষণ পর্যন্ত শান্ত হইয়া চিত্রাপিতের মতো বসিয়া রহিল । VN) আজ সকাল হইতে গোরার ঘরে খুব একটা আন্দােলন উঠিয়াছে। প্রথমে মহিম তাহার ছক টানিতে টানিতে আসিয়া গোরাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তা হলে, এতদিন পরে বিনয় শিকলি কাটল বুঝি ?” গােরা কথাটা বুঝিতে পারিল না, মহিমের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। মহিম কহিলেন “আমাদের কাছে আর ভঁাড়িয়ে কী হবে বল ? তোমার বন্ধুর খবর তো আর চাপা রইল না- ঢাক বেজে উঠেছে। এই দেখো-না।” বলিয়া মহিম গোরার হাতে একখানা বাংলা খবরের কাগজ দিলেন। তাঁহাতে অদ্য রবিবারে বিনয়ের ব্ৰাহ্মসমাজে দীক্ষাগ্রহণের সংবাদ উপলক্ষ করিয়া এক তীব্ৰ প্ৰবন্ধ বাহির হইয়াছে। গোরা যখন জেলে ছিল সেই সময়ে ব্ৰাহ্মসমাজের কন্যাদায়গ্ৰস্ত কোনাে কোনাে বিশিষ্ট সভ্য এই দুর্বলচিত্ত যুবককে গোপন প্রলোভনে বশ করিয়া সনাতন হিন্দুসমােজ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া লইয়াছে বলিয়া