পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা VS S বধিয়া দিলে মারীকে আহবান করিয়া আনা হইবে— ইহা আমি নিশ্চয় জানি। অতএব, যে শক্তি তোমাদিগকে দুনিবার বেগে সুখ স্বচ্ছন্দতা ও সমাজবিধির বাহিরে আকর্ষণ করিয়া লইয়া চলিয়াছেন তাহাকেই ভক্তির সহিত প্ৰণাম করিয়া তাঁহারই হস্তে তোমাদের দুইজনকে সমর্পণ করিলাম, তিনিই তোমাদের জীবনে সমস্ত নিন্দাগ্নানি ও আত্মীয়বিচ্ছেদকে সার্থক করিয়া তুলুন। তিনিই তোমাদিগকে দুৰ্গম পথে আহবান করিয়াছেন, তিনিই তোমাদিগকে গম্যস্থানে লইয়া যাইবেন ।” গোরা এই চিঠি পড়িয়া কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিলে পর বিনয় কহিল, “পরেশবাবুর্তার দিক থেকে যেমন সম্মতি দিয়েছেন, তেমনি তোমার দিক থেকেও, গােরা, তোমাকে সম্মতি দিতে হবে।” গোরা কহিল, “পরেশবাবু সন্মতি দিতে পারেন, কেননা নদীর যে ধারা কুল ভাঙছে, সেই ধারাই তাদের। আমি সম্মতি দিতে পারি নে, কেননা আমাদের ধারা কুলকে রক্ষা করে। আমাদের এই কুলে শতসহস্ৰ বৎসরের অভ্ৰভেদী কীর্তি রয়েছে, আমরা কোনােমতেই বলতে পারব না। এখানে প্রকৃতির নিয়মই কাজ করতে থাক। আমাদের কূলকে আমরা পাথর দিয়েই বঁধিয়ে রাখব, তাতে আমাদের নিন্দাই কর আর যাই কর। এ আমাদের পবিত্র প্রাচীন পুরী— এর উপরে বৎসরে বৎসরে নূতন মাটির পলি পড়বে। আর চাষার দলে লাঙল নিয়ে এর জমি চাষবে, এটা আমাদের অভিপ্রেত নয়, তাতে আমাদের যা লোকসান হয় হােক । এ আমাদের বাস করবার, এ চাষ করবার নয় । অতএব তোমাদের কৃষিবিভাগ থেকে আমাদের এই পাথরগুলোকে যখন কঠিন বলে নিন্দ কর তখন তাতে আমরা মর্মান্তিক লজ্জা বোধ করি নে ৷” বিনয় কহিল, “অর্থাৎ, সংক্ষেপে, তুমি আমাদের এই বিবাহকে স্বীকার করবে না।” গোরা কহিল, “নিশ্চয় করব না ।” বিনয় কহিল, “এবং—” গোরা কহিল, “এবং তোমাদের ত্যাগ করব ।” গোরা কহিল, “তা হলে অন্য কথা হত । গাছের আপনি ডাল ভেঙে পড়ে যদি পর হয়ে যায়। তবে গাছ তাকে কোনােমতেই পূর্বের মতো আপন করে ফিরে নিতে পারে না, কিন্তু বাইরে থেকে যে লতা এগিয়ে আসে তাকে সে আশ্রয় দিতে পারে, এমন-কি, ঝড়ে ভেঙে পড়লে আবার তাকে তুলে নিতে কোনাে বাধা থাকে না। আপনি যখন পর হয় তখন তাকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করা ছাড়া অন্য কোনো গতি নেই। সেইজন্যেই তো এত বিধিনিষেধ, এত প্ৰাণপণ টানাটানি।” বিনয় কহিল, “সেইজন্যেই তো ত্যাগের কারণ অত হালকা এবং ত্যাগের বিধান অত সুলভ হওয়া উচিত ছিল না । হাত ভাঙলে আর জোড়া লাগে না বটে, সেইজন্যেই কথায় কথায় হাত ভাঙেও না । তার হাড় খুব মজবুত। যে সমাজে অতি সামান্য ঘা লাগলেই বিচ্ছেদ ঘটে এবং সে বিচ্ছেদ চিরবিচ্ছেদ হয়ে দাঁড়ায় সে সমাজে মানুষের পক্ষে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা— কাজকর্ম করার পক্ষে বাধা কত সে কথা কি চিন্তা করে দেখবে না ?” গোরা কহিল, “সে চিন্তার ভার আমার উপর নেই। সমাজ এমন সমগ্রভাবে এমন বড়োরকম করে চিন্তা করছে যে আমি টেরও পাচ্ছি নে সে ভাবছে। হাজার হাজার বৎসর ধরে সে ভেবেওছে এবং আপনাকে রক্ষাও করে এসেছে, এই আমার ভরসা। পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে বেঁকে চলছে কি সোজা চলছে, ভুল করছে কি করছে না, সে যেমন আমি ভাবি নে এবং না ভেবে আজ পর্যন্ত আমিঠকি নি— আমার সমাজ সম্বন্ধেও আমার সেই ভাব ।” বিনয় হাসিয়া কহিল, “ভাই গোরা, ঠিক এই সব কথা আমিও এতদিন এমনি করেই বলে এসেছি, আজ আবার আমাকেও সে কথা শুনতে হবে তা কে জানত! কথা বানিয়ে বলবার শাস্তি আজ আমাকে ভোগ করতে হবে সে আমি বেশ বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তর্ক করে কোনাে লাভ নেই। কেননা, একটা কথা আমি আজ খুব নিকটের থেকে দেখতে পেয়েছি, সেটি পূর্বে দেখি নি— আজি বুঝেছি মানুষের জীবনের গতি মহানদীর মতো, সে আপনার বেগে অভাবনীয় রূপে এমন নূতন নূতন