পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V)〉br রবীন্দ্র-রচনাবলী কোনাে দিকে দৃষ্টিপাত না করিয়া বাহিরে চলিয়া গেল। সুচরিতা একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া পুনরায় পাকশালার কাজে আসিয়া নিযুক্ত হইল। গােরা গলির মােড়ের কাছে আসিতেই হারানবাবুর সঙ্গে তাহার দেখা হইল। হারানবাবু একটু হাসিয়া কহিলেন, “আজ সকালেই যে !” গোরা তাহার কোনো উত্তর করিল না। হারানবাবু পুনরায় একটু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ওখানে গিয়েছিলেন বুঝি ? সুচরিতা বাড়ি আছে তো ?” গোরা কহিল, “হাঁ।” বলিয়াই সে হন হন করিয়া চলিয়া গেল। পাইলেন ; সুচরিতার পালাইবার পথ ছিল না, মাসিও নিকটে ছিলেন না। জুলুল্লাস করলেন,"স্টেমােহনবন্ধু সঙ্গ একেত্র বন্ধ হল। তিিন এখােন এক্ষে 99ر সুচরিতা তাহার কোনো জবাব না করিয়া হঠাৎ হাঁড়িকুড়ি লইয়া অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া উঠিল, যেন এখন তাহার নিশ্বাস ফেলিবার অবকাশ নাই এরকম ভাবটা জানাইল । কিন্তু হারানবাবু তাহাতে নিরস্ত হইলেন না । তিনি ঘরের বাহিরে সেই প্রাঙ্গণে দাড়াইয়া কথাবার্তা আরম্ভ করিয়া দিলেন । হরিমোহিনী সিঁড়ির কাছে আসিয়া দুই-তিন বার কাশিলেন, তাহাতেও কিছুমাত্র ফল হইল না । হরিমোহিনী হারানবাবুর সম্মুখে বাহির হন তবে এ বাড়িতে এই উদ্যমশীল যুবকের অদম্য উৎসাহ হইতে তিনি এবং সুচরিতা কোথাও আত্মরক্ষা করিতে পরিবেন না | এইজন্য হারানবাবুর ছায়া দেখিলেও তিনি এতটা পরিমাণে ঘোমটা টানিয়া দেন যে তাহা তাহার বধূবয়সেও তাহার পক্ষে অতিরিক্ত বলিয়া গণ্য হইতে পারিত । r হারানবাবু কহিলেন, “সুচরিতা, তোমরা কোন দিকে চলেছ বলে দেখি । কোথায় গিয়ে পৌঁছবে ? বোধ হয় শুনেছ। ললিতার সঙ্গে বিনয়বাবুর হিন্দুমতে বিয়ে হবে ? তুমি জান এজন্যে কে দায়ী ?" সুচরিতার নিকট কোনো উত্তর না পাইয়া হারানবাবু স্বর নত করিয়া গভীরভাবে কহিলেন, “দায়ী তুমি।” হারানবাবু মনে করিয়াছিলেন, এতবড়ো একটা সাংঘাতিক অভিযোগের আঘাত সুচরিতা সহা করিতে পরিবে না। কিন্তু সে বিনা বাক্যব্যয়ে কাজ করিতে লাগিল দেখিয়া তিনি স্বর আরো গভীর বলছি, দায়ী তুমি । বুকের উপরে ডান হাত রেখে কি বলতে পার যে, এজন্যে ব্ৰাহ্মসমাজের কাছে তোমাকে অপরাধী হতে হবে না ?” সুচরিতা উনানের উপরে নীরবে তেলের কড়া চাপাইয়া দিল এবং তেল চড় বড় শব্দ করিতে व्लानि । হারান বলিতে লাগিলেন, “তুমিই বিনয়বাবুকে এবং গৌরমোহনবাবুকে তোমাদের ঘরে এনেছ এবং তাদের এতদূর পর্যন্ত প্রশ্রয় দিয়েছ যে, আজ তোমাদের ব্ৰাহ্মসমাজের সমস্ত মান্য বন্ধুদের চেয়ে এরা দুজনেই তোমাদের কাছে বড়ো হয়ে উঠেছে। তার ফল কী হয়েছে দেখতে পােচ্ছ ? আমি কি প্রথম থেকেই বার বার সাবধান করে দিই নি ? আজি কী হল ? আজি ললিতাকে কে নিবৃত্ত করবে ? তুমি ভাবিছ ললিতার উপর দিয়েই বিপদের অবসান হয়ে গেল । তা নয় । আমি আজ তোমাকে সাবধান করে দিতে এসেছি। এবার তোমার পালা। আজ ললিতার দুর্ঘটনায় তুমি নিশ্চয়ই মনে মনে অনুতাপ করছ, কিন্তু এমন দিন অনতিদূরে এসেছে যেদিন নিজের অধঃপতনে তুমি অনুতাপমাত্রও করবে না। কিন্তু, সুচরিতা, এখনো ফেরবার সময় আছে। একবার ভেবে দেখো, একদিন কতবড়ো মহৎ আশার মধ্যে আমরা দুজনে মিলেছিলুম- আমাদের সামনে জীবনের কর্তব্য কী উজ্জ্বল ছিল, ব্ৰাহ্মসমাজের ভবিষ্যৎ কী উদারভাবেই প্রসারিত হয়েছিল-- আমােদর কত সংকল্প ছিল এবং কত পাথেয় আমরা