পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૭. રે રે রবীন্দ্র-রচনাবলী আনন্দময়ী কহিলেন, “কেন হবে না ? কৰ্তাকে আমি রাজি করেছি।” গোরা কহিল, “না মা, এ বিয়ে এখানে হতে পারবে না— আমি বলছি, আমার কথা শোনো।” আনন্দময়ী কহিলেন, “কেন, বিনয় তো ওদের মতে বিয়ে করছে না।” গােরা কহিল, “ও-সমস্ত তর্কের কথা। সমাজের সঙ্গে ওকালতি চলবে না। বিনয় যা খুশি করুক, এ বিয়ে আমরা মানতে পারি নে। কলকাতা শহরে বাড়ির অভাব নেই। তার নিজেরই তো বাসা আছে ।” বাড়ি অনেক মেলে আনন্দময়ী তাহা জানিতেন। কিন্তু বিনয় যে আত্মীয়বন্ধু সকলের দ্বারা র্তাহার মনে বাজিতেছিল। সেইজন্য তিনি তঁহাদের বাড়ির যে অংশ ভাড়া দিবার জন্য স্বতন্ত্র রহিয়াছে সেইখানে বিনয়ের বিবাহ দিবার কথা মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন । ইহাতে সমাজের সঙ্গে কোনো বিরোধ না বাধাইয়া তীহাদের আপনি বাড়িতে শুভকর্মের অনুষ্ঠান করিয়া তিনি তৃপ্তিলাভ করিতে পারিতেন। গোরার দৃঢ় আপত্তি দেখিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “তোমাদের যদি এতে এতই অমত তা হলে অন্য জায়গাতেই বাড়ি ভাড়া করতে হবে । কিন্তু তাতে আমার উপরে ভারি টানাটানি পড়বে | তা হােক, যখন এটা হতেই পারবে না। তখন এ নিয়ে আর ভেবে কী হবে ।” গোরা কহিল, “মা, এ বিবাহে তুমি যোগ দিলে চলবে না।” আনন্দময়ী কহিলেন, “সে কী কথা গোরা, তুই বলিস কী ! আমাদের বিনয়ের বিয়েতে আমি যোগ দেব না তো কে দেবে ।” গোরা কহিল, “সে কিছুতেই হবে না মা !” আনন্দময়ী কহিলেন, “গোরা, বিনয়ের সঙ্গে তোর মতের মিল না হতে পারে, তাই বলে কি তার সঙ্গে শত্রুতা করতে হবে ?” গোরা একটু উত্তেজিত হইয়া উঠিয়া কহিল, “মা, এ কথা তুমি অন্যায় বলছি । আজ বিনয়ের বিয়েতে আমি যে আমোদ করে যোগ দিতে পারছি নে এ কথা আমার পক্ষে সুখের কথা নয়। বিনয়কে আমি যে কতখানি ভালোবাসি সে আর কেউ না জানে তো তুমি জান । কিন্তু, মা, এ ভালোবাসার কথা নয়, এর মধ্যে শত্রুত মিত্ৰত কিছুমাত্র নেই। বিনয় এর ফলাফল সমস্ত জেনেশুনেই এ কাজে প্রবৃত্ত হয়েছে। আমরা তাকে পরিত্যাগ করি নি, সেই আমাদের পরিত্যাগ করেছে। সুতরাং এখন যে বিচ্ছেদ ঘটেছে সেজন্যে সে এমন কোনো আঘাত পাবে না। যা তার প্রত্যাশার অতীত ।” আনন্দময়ী কহিলেন, “গোরা, বিনয় জানে এই বিয়েতে তোমার সঙ্গে তার কোনোরকম যোগ থাকবে না, সে কথা ঠিক । কিন্তু এও সে নিশ্চয় জানে শুভকৰ্মে আমি তাকে কোনোমতেই পরিত্যাগ করতে পারব না । বিনয়ের বউকে আমি আশীর্বাদ করে গ্রহণ করব না। এ কথা বিনয় যদি মনে করত। তা হলে আমি বলছি সে প্ৰাণ গেলেও এ বিয়ে করতে পারত না । আমি কি বিনয়ের মন জানি নে !” বলিয়া আনন্দময়ী চোখের কোণ হইতে এক ফোটা অশ্রু মুছিয়া ফেলিলেন । বিনয়ের জন্য গোরার মনের মধ্যে যে গভীর বেদনা ছিল তাহা আলোড়িত হইয়া উঠিল । তবু সে বলিল, “মা, তুমি সমাজে আছ এবং সমাজের কাছে তুমি ঋণী, এ কথা তোমাকে মনে রাখতে হবে।” আনন্দময়ী কহিলেন, “গোরা, আমি তো তোমাকে বার বার বলেছি, সমাজের সঙ্গে আমার যোগ অনেক দিন থেকেই কেটে গেছে। সেজন্যে সমাজ আমাকে ঘূণা করে, আমিও তার থেকে দূরে থাকি ৷” গোরা কহিল, “মা, তোমার এই কথায় আমি সব চেয়ে আঘাত পাই ।” আনন্দময়ী তাহার অশ্রু-ছলছল স্নিগ্ধদৃষ্টিদ্বারা গোরার সর্বাঙ্গ যেন স্পর্শ করিয়া কহিলেন, “বাছা, ঈশ্বর জানেন তোকে এ আঘাত থেকে বাচাঁবার সাধ্য আমার নেই।” গোরা উঠিয়া দাড়াইয়া কহিল, “তা হলে আমাকে কী করতে হবে তোমাকে বলি। আমি বিনয়ের