পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ N 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী বসিয়া অত্যন্ত উচ্চ অঙ্গের পরমার্থতত্ত্ব-আলোচনায় প্রবৃত্ত ছিলেন। গৃহীদের মুক্তি আছে কি না অতিশয় বিনীত ব্যাকুলম্বরে এই প্রশ্ন তুলিয়া তিনি করজোড়ে অবহিত হইয়া এমনি একান্ত ভক্তি ও আগ্রহের ভাবে তাহার উত্তর শুনিতে বসিয়াছিলেন, যেন মুক্তি পাইবার জন্য তাহার যাহা-কিছু আছে সমস্তই তিনি নিঃশেষে পণ করিয়া বসিয়াছেন। গৃহীদের মুক্তি নাই। কিন্তু স্বৰ্গ আছে, এই কথা বলিয়া মানিতেছেন না । মুক্তি তাহার নিতান্তই চাই, স্বর্গে তাহার কোনো প্রয়োজন নাই। কোনোমতে কন্যাটার বিবাহ দিতে পারিলেই সন্ন্যাসীর পদসেবা করিয়া তিনি মুক্তির সাধনায় উঠিয়া-পডিয়া লাগিবেন ; কাহার সাধ্য আছে ইহা হইতে তাহাকে নিরস্ত করে । কিন্তু কন্যার বিবাহ তো সহজ ব্যাপার নয়- এক, যদি বাবা দয়া করেন । V)8 মাঝখানে নিজের একটুখানি আত্মবিস্মৃতি ঘটিয়াছিল এই কথা স্মরণ করিয়া গােরা পূর্বের চেয়ে আরো বেশি কড়া হইয়া উঠিল। সে যে সমাজকে ভুলিয়া প্রবল একটা মোহে অভিভূত হইয়াছিল, নিয়মপালনের শৈথিল্যাকেই সে তাহার কারণ বলিয়া স্থির করিয়াছিল। সকালবেলায় সন্ধ্যাহিক সারিয়া গোরা ঘরের মধ্যে আসিতেই দেখিল, পরেশবাবু বসিয়া আছেন। তাহার বুকের ভিতরে যেন একটা বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল ; পরেশের সঙ্গে কোনাে-এক সূত্রে তাহার জীবনের যে একটা নিগুঢ় আত্মীয়তার যোগ আছে তাহা গোরার শিরাস্নায়ুগুলা পর্যন্ত না মানিয়া থাকিতে পারিল না | গোরা পরেশকে প্ৰণাম করিয়া বসিল । পরেশ কহিলেন, “বিনয়ের বিবাহের কথা তুমি অবশ্য শুনেছ ?” গোরা কহিল, “হঁ৷ ” পরেশ কহিলেন, “সে ব্ৰাহ্মমতে বিবাহ করতে প্ৰস্তুত নয়।” গোরা কহিল, “তা হলে তার এ বিবাহ করাই উচিত নয় ।” পরেশ একটু হাসিলেন, এ কথা লইয়া কোনো তর্কে প্রবৃত্ত হইলেন না। তিনি কহিলেন, “আমাদের সমাজে এ বিবাহে কেউ যোগ দেবে না ; বিনয়ের আত্মীয়েরাও কেউ আসবেন না শুনছি। আমার কন্যার দিকে একমাত্র কেবল আমি আছি, বিনয়ের দিকে বোধ হয় তুমি ছাড়া আর কেউ নেই, এইজন্য এ সম্বন্ধে তোমার সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছি।” গোরা মাথা নাড়িয়া কহিল, “এ সম্বন্ধে আমার সঙ্গে পরামর্শ কী করে হবে ! আমি তো এর মধ্যে নেই ।” পরেশ বিস্মিত হইয়া গোরার মুখের দিকে ক্ষণকাল দৃষ্টি রাখিয়া কহিলেন, “তুমি নেই!" পরেশের এই বিস্ময়ে গোরা মুহুর্তকালের জন্য একটা সংকোচ অনুভব করিল। সংকোচ অনুভব করিল বলিয়াই পরীক্ষণে দ্বিগুণ দৃঢ়তার সহিত কহিল, “আমি এর মধ্যে কেমন করে থাকব!" পরেশবাবু কহিলেন, “আমি জানি তুমি তার বন্ধু ; বন্ধুর প্রয়োজন এখনই কি সব চেয়ে বেশি নয় ?” গোরা কহিল, “আমি তার বন্ধু, কিন্তু সেইটেই তো সংসারে আমার একমাত্র বন্ধন এবং সকলের চেয়ে বড়ো বন্ধন নয় ।” পরেশবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “গীের, তুমি কি মনে কর বিনয়ের আচরণে কোনো অন্যায় অধৰ্ম প্ৰকাশ পাচ্ছে ?” গোরা কহিল, “ধর্মের দুটাে দিক আছে যে । একটা নিত্য দিক, আর-একটা লৌকিক দিক। ধর্ম যেখানে সমাজের নিয়মে প্ৰকাশ পাচ্ছেন সেখানেও তাকে অবহেলা করতে পারা যায় না, তা করলে সংসার ছারখার হয়ে যায় ।” পরেশবাবু কহিলেন, “নিয়ম তো অসংখ্য আছে, কিন্তু সকল নিয়মেই যে ধর্ম প্রকাশ পাচ্ছেন এটা