পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૭૨\ রবীন্দ্র-রচনাবলী করিবার অত্যন্ত একটি সত্য পথ চাহিতেছে— এ-সমস্ত কিছুই তাহার ভালো লাগিতেছে না। এ দিকে প্ৰায়শ্চিত্তসভার আয়োজন চলিতেছে। এই আয়োজনে গোরা একটু বিশেষ উৎসাহ বোধ করিয়াছে। এই প্রায়শ্চিত্ত কেবল জেলখানার অশুচিতার প্রায়শ্চিত্ত নহে, এই প্ৰায়শ্চিত্তের দ্বারা সকল দিকেই সম্পূর্ণ নির্মল হইয়া আবার একবার যেন নূতন দেহ লইয়া সে আপনার কর্মক্ষেত্রে নবজন্ম লাভ করিতে চায়। প্ৰায়শ্চিত্তের বিধান লওয়া হইয়াছে দিনস্থিরও হইয়া গেছে, পূর্ব ও পশ্চিম-বঙ্গের বিখ্যাত অধ্যাপক-পণ্ডিতদিগকে নিমন্ত্রণপত্ৰ দিবার উদযোগ চলিতেছে। গোরার দলে ধনী যাহারা ছিল তাহারা টাকাও সংগ্ৰহ করিয়া তুলিয়াছে দলের লোকে সকলেই মনে করিতেছে দেশে অনেক দিন পরে একটা কাজের মতো কাজ হইতেছে! অবিনাশ গোপনে আপনি সম্প্রদায়ের সকলের সঙ্গে পরামর্শ করিয়াছে সেইদিন সভায় সমস্ত পণ্ডিতদিগকে দিয়া গােরাকে ধান্যদূর্ব ফুলচন্দন প্রভৃতি বিবিধ উপচারে “হিন্দুধর্মপ্রদীপ উপাধি দেওয়া হইবে । এই সম্বন্ধে সংস্কৃত কয়েকটি শ্লোক লিখিয়া, তাহার নিম্নে সমস্ত ব্ৰাহ্মণপণ্ডিতের নামস্বাক্ষর করাইয়া, সোনার জলের কালিতে ছাপাইয়া, চন্দনকাঠের বাক্সের মধ্যে রাখিয়া তাহাকে উপহার দিতে হইবে । সেইসঙ্গে ম্যাক্সমুলারের দ্বারা প্রকাশিত একখণ্ড ঋগবেদগ্রন্থ বহুমূল্য মরক্কো চামড়ায় বাধাইয়া সকলের চেয়ে প্রাচীন ও মান্য অধ্যাপকের হাত দিয়া তাহাকে ভারতবর্ষের আশীর্বাদী-স্বরূপ দান করা হইবে— ইহাতে আধুনিক ধর্মভ্ৰষ্টতার দিনে গোরাই যে সনাতন বেদবিহিত ধর্মের যথার্থ রক্ষাকর্তা এই ভাবটি অতি সুন্দররাপে প্রকাশিত হইবে । এইরূপে সেদিনকার কর্মপ্রণালীকে অত্যন্ত হৃদ্য এবং ফলপ্ৰদ করিয়া তুলিবার জন্য গোরার অগোচরে তাহার দলের লোকের মধ্যে প্ৰতােহই মন্ত্রণা চলিতে লাগিল । ど@ শ্ৰীচরণশীর্বাদে অত্রস্থ মঙ্গল, আপনকার কুশলসমাচারে আমাদের চিন্তা দূর করবেন।” বলা বাহুল্য হরিমোহিনী তাঁহাদের বাড়ি পরিত্যাগ করার পর হইতেই এই চিন্তা তাহারা বহন করিয়া আসিতেছে, তথাপি কুশলসমাচারের অভাব দূর করিবার জন্য তাহারা কোনােপ্রকার চেষ্টা করে নাই। খুদি, পটল ভজহরি প্রভৃতি সকলের সংবাদ নিঃশেষ করিয়া উপসংহারে কৈলাস লিখিতেছে— ‘আপনি যে পত্রটির কথা লিখিয়াছেন তাহার সমস্ত খবর ভালো করিয়া জানাইবেন । আপনি বলিয়াছেন, তাহার বয়স বারো-তেরো হইবে, কিন্তু বাড়ন্ত মেয়ে, দেখিতে কিছু ডাগর দেখায়, তাহাতে বিশেষ ক্ষতি হইবে না । তাহার যে সম্পত্তির কথা লিখিয়াছেন তাহাতে তাহার জীবনস্বত্ব অথবা চিরস্বত্ব তাহা ভালো করিয়া খোজ করিয়া লিখিলে অগ্রজমহাশয়দিগকে জানাইয়া তীহাদের মত লাইব । বোধ করি, তাহদের অমত না হইতে পারে ; পত্রটির হিন্দুধর্মে নিষ্ঠা আছে শুনিয়া নিশ্চিন্ত হইলাম, কিন্তু এতদিন সে ব্ৰাহ্মঘরে মানুষ হইয়াছে। এ কথা যাহাতে প্রকাশ না হইতে পারে সেজন্য চেষ্টা করিতে হইবে— অতএব এ কথা আর কাহাকেও জানাইবেন না । আগামী পূর্ণিমায় চন্দ্ৰগ্ৰহণে গঙ্গাস্নানের যোগ আছে, যদি সুবিধা পাই সেই সময়ে গিয়া কন্যা দেখিয়া আসিব ।” এতদিন কলিকাতায় কোনোপ্রকারে কাটিয়াছিল, কিন্তু শ্বশুরঘরে ফিরিবার আশা যেমনি একটু অঙ্কুরিত হইয়া উঠিল অমনি হরিমােহিনীর মন আর ধৈর্য মানিতে চাহিল না। নির্বাসনের প্রত্যেক দিন র্তাহার পক্ষে অসহ্য বোধ হইতে লাগিল। তাহার ইচ্ছা করিতে লাগিল এখনই সুচরিতাকে বলিয়া দিন স্থির করিয়া কােজ সারিয়া ফেলি। তবু তাড়াতাড়ি করিতে তাহার সাহস হইল না। সুচরিতাকে যতই তিনি নিকটে করিয়া দেখিতেছেন ততই তিনি ইহা বুঝিতেছেন যে, তাহাকে তিনি বুঝিতে পারেন নাই। হরিমোহিনী অবসর প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন এবং পূর্বের চেয়ে সুচরিতার প্রতি বেশি করিয়া সতর্কতা প্রয়োগ করিলেন। আগে পূজাহিকে তাহার যত সময় লাগিত এখন তাহা কমিয়া আসিবার উপক্রম হইল ; তিনি সুচরিতাকে আর চােখের আড়াল করিতে চান না। সুচরিতা দেখিল গােরার আসা হঠাৎ বন্ধ হইয়া গেল। সে বুঝিল হরিমােহিনী তাঁহাকে কিছু