পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা V NA বুলিয়াছেন। সে কহিল, "আচ্ছা বেশ, তিনি নাই আসিলেন, কিন্তু তিনিই আমার গুরু, আমার গুরু!” সম্মুখে যে গুরু থাকেন তাহার চেয়ে অপ্রত্যক্ষ গুরুর জোর অনেক বেশি। কেননা, নিজের মন তুখন গুরুর বিদ্যমানতার অভােব আপনার ভিতর হইতে পুরাইয়া লয়। গোরা সামনে থাকিলে সুচরিতা যেখানে তর্ক করিত এখন সেখানে গোরার রচনা পড়িয়া তাহার বাক্যগুলিকে বিনা প্রতিবাদে গ্ৰহণ করে। না বুঝিতে পারিলে বলে তিনি থাকিলে নিশ্চয় বুঝাইয়া দিতেন। কিন্তু গোরার সেই তেজস্বী মূর্তি দেখিবার এবং তাহার সেই বজ্রগর্ভ মেঘগর্জনের মতো বাক্য শুনিবার ক্ষুধা কিছুতেই কি মিটিতে চায়! এই তাহার নিবৃত্তিহীন আন্তরিক ঔৎসুক্য একেবারে নিরন্তর হইয় তাহার শরীরকে যেন ক্ষয় করিতে লাগিল। থাকিয়া থাকিয়া সুচরিতা অত্যন্ত ব্যথার সহিত মনে করে কত লোক অতি অনায়াসেই রাত্রিদিন গোরার দর্শন পাইতেছে, কিন্তু গোরার দর্শনের কোনো মূল্য তাহারা জানে না | 鼻 ললিতা আসিয়া সুচরিতার গলা জড়াইয়া ধরিয়া একদিন অপরাঙ্কে কহিল, “ভাই সুচিদিদি ” সুচরিতা কহিল, “কী ভাই ললিতা ?” ললিত কহিল, “সব ঠিক হয়ে গেছে।” ললিত কহিল, “সোমবার ।” ললিতা মাথা নাড়া দিয়া কহিল, “সে-সব আমি জানি নে, বাবা জানেন ।” সুচরিতা বাহুর দ্বারা ললিতার কটি বেষ্টন করিয়া কহিল, “খুশি হয়েছিস ভাই ?” ললিত কহিল, “খুশি কেন হব না !” সুচরিতা কহিল, “যা চেয়েছিল সবই পেলি, এখন কারও সঙ্গে কোনাে ঝগড়া করবার কিছুই রইল না, সেইজন্যে মনে ভয় হয় পাছে তোর উৎসাহ কমে যায় ।” ললিতা হাসিয়া কহিল, “কেন, ঝগড়া করবার লোকের অভাব হবে কেন ? এখন আর বাইরে খুঁজতে হবে না ।” সুচরিতা ললিতার কপােলে তর্জনীর আঘাত করিয়া কহিল, “এই বুঝি ! এখন থেকে বুঝি এই সমস্ত মতলব আঁটা হচ্ছে। আমি বিনয়কে বলে দেব, এখনাে সময় আছে, বেচারা সাবধান হতে পারে ।” ললিতা কহিল, “তোমার বেচারার আর সাবধান হবার সময় নেই গাে । আর তার উদ্ধার নেই। কুষ্ঠিতে ফাড়া যা ছিল তা ফলে গেছে, এখন কপালে করাঘােত আর ক্ৰন্দন।” সুচরিতা গভীর হইয়া কহিল, “আমি যে কত খুশি হয়েছি সে আর কী বলব ললিতা! বিনয়ের মতো স্বামীর যেন তুই যোগ্য হতে পারিস এই আমি প্রার্থনা করি।" ললিতা কহিল, “ইস্ ! তাই বৈকি! আর, আমার যােগ্য বুঝি কাউকে হতে হবে না! এ সম্বন্ধে একবার তীর সঙ্গে কথা কয়েই দেখে-না। তার মতটা একবার শুনে রাখে— তা হলে তোমারও মনে