পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VOS রবীন্দ্র-রচনাবলী আমাকে তাহার প্রয়োজন আছে। এ কথা তাহার নিজের মুখে একদিন আমাকে বলিয়াছেন। আজ অতি তুচ্ছ জল্পনায় এ কথা কেমন করিয়া ভুলিলেন ' সুচরিতা তাহার গলা জড়াইয়া কহিল, “কী ভাই ব্যক্তিয়ার !” সতীশ কহিল, “সোমবারে ললিতাদিদির বিয়ে— এ ক'দিন আমি বিনয়বাবুর বাড়িতে গিয়ে থাকব । তিনি আমাকে ডেকেছেন।” সতীশ কহিল, “মাসিকে বলেছিলুম, তিনি রাগ করে বললেন, আমি ও-সব কিছু জানি নে, তোমার দিদিকে বলো, তিনি যা ভালো বােঝেন তাই হবে । দিদি, তুমি বারণ কোরো না । সেখানে আমার পড়াশুনার কিছু ক্ষতি হবে না, আমি রোজ পড়ব, বিনয়বাবু আমার পড়া বলে দেবেন।” সুচরিতা কহিল, “কাজকর্মের বাড়িতে তুই গিয়ে সকলকে অস্থির করে দিবি ।” সতীশ বাগ্র হইয়া কহিল, “না দিদি, আমি কিছু অস্থির করব না।” সুচরিতা কহিল, “তোর খুদে কুকুরটাকে সেখানে নিয়ে যাবি নাকি ?” লাল চিঠির কাগজে ছাপানো একটা আলাদা নিমন্ত্রণ-চিঠি এসেছে- তাতে লিখেছে তাকে সপরিজনে গিয়ে জলযোগ করে আসতে হবে ।” সুচরিতা কহিল, “পরিজিনটি কে ?” যেতে বলেছেন দিদি, সেটা আমাকে দিয়ো- আমি ভাঙব না ।” সুচরিতা কহিল, “ভাঙলেই যে আমি বাচি । এতক্ষণে তা হলে বোঝা গেল— তার বিয়েতে আগিন বাজাবার জন্যেই বুঝি তোর বন্ধু তোকে ডেকেছেন ? রোশন-চৌকিওয়ালাকে বুঝি একেবারে ফাঁকি দেবার মতলব ?” সতীশ অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উঠিয়া কহিল, “না, ককখনো না। বিনয়বাবু বলেছেন, আমাকে তার মিতবর করবেন ! মিতবরকে কী করতে হয় দিদি ?” সুচরিতা কহিল, “সমস্ত দিন উপোস করে থাকতে হয় ।” সতীশ এ কথা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস করিল। তখন সুচরিতা সতীশকে কোলের কাছে দৃঢ় করিয়া টানিয়া ইহার উত্তর সতীশের মনের মধ্যে প্ৰস্তুত ছিল । তাহার ক্লাসের শিক্ষকই তাহার কাছে অপ্ৰতিহত ক্ষমতা ও অসাধারণ পণ্ডিত্যের আদর্শস্থল ছিল— সে পূর্ব হইতেই মনে মনে স্থির করিয়া রাখিয়ছিল সে বড়ো হইলে মাস্টারমশায় হইবে । সুচরিতা তাহাকে কহিল, “অনেক কাজ করবার আছে ভাই। আমাদের দুই ভাইবােনের কাজ আমরা দুজনে মিলে করব। কী বলিস সতীশ ? আমাদের দেশকে প্রাণ দিয়ে বড়ো করে তুলতে হবে। বড়ো করব কী ! আমাদের দেশের মতো বড়ো আর কী আছে! আমাদের প্রাণকেই বড়ো করে তুলতে হবে । জানিস ? বুঝতে পেরেছিস ?” বুঝিতে পারিল না। এ কথা সতীশ সহজে স্বীকার করিবার পাত্র নয়। সে জোরের সহিত বলিল, "" সুচরিতা কহিল, “আমাদের যে দেশ, আমাদের যে জাত, সে কতবড়ো তা জানিস! সে আমি তোকে বোঝােব কেমন করে! এ এক আশ্চর্য দেশ। এই দেশকে পৃথিবীর সকলের চুড়ার উপরে বসাবার জন্যে কত হাজার হাজার বৎসর ধরে বিধাতার আয়োজন হয়েছে, দেশ বিদেশ থেকে কত লোক এসে এই আয়োজনে যোগ দিয়েছে, এ দেশে। কত মহাপুরুষ জন্মেছেন, কত মহাযুদ্ধ ঘটেছে, কত মহাবােক্য এইখান থেকে বলা হয়েছে, কত মহাতপস্যা এইখানে সাধন করা হয়েছে, ধর্মকে এ দেশ