পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

* \\)\\ রবীন্দ্র-রচনাবলী মা থাকিতেও শুভকৰ্মে ললিতাকে তাহার মা পরিত্যাগ করিয়াছেন, সে করুণায় আনন্দময়ীর হৃদয় পূর্ণ হইয়া রহিয়াছে। সেই কারণেই এই বিবাহে যাহাতে কোনাে অনাদর-অশ্ৰদ্ধার লক্ষণ না থাকে সেইজন্য তিনি একান্তমনে চেষ্টা করিতেছেন। তিনি ললিতার মায়ের স্থান লইয়া নিজের হাতে ললিতাকে সাজাইয়া দিবেন, বরকে বরণ করিয়া লইবার ব্যবস্থা করিবেন- যদি নিমন্ত্রিত দুই-চারি জন আসে তাঁহাদের আদর-অভ্যর্থনার লেশমাত্র ত্রুটি না হয় তাহা দেখিবেন, এবং এই নূতন বাসাবাড়িকে এমন করিয়া সাজাইয়া তুলিবেন যাহাতে ললিতা ইহাকে একটা বাসস্থান বলিয়া অনুভব করিতে পারে, ইহাই তাহার সংকল্প । সুচরিতা কহিল, “এতে তোমাকে নিয়ে কোনো গোলমাল হবে না ?” বাড়িতে মহিম যে তোলপাড় বাধাইয়াছে তাহা স্মরণ করিয়া আনন্দময়ী কহিলেন, “তা হতে পারে, তাতে কী হবে ! গোলমাল কিছু হয়েই থাকে ; চুপ করে সয়ে থাকলে আবার কিছুদিন পরে সমস্ত (क05९3 याश ।' সুচরিতা জানিত এই বিবাহে গোরা যোগ দেয় নাই। আনন্দময়ীকে বাধা দিবার জন্য গোরার কোনো চেষ্টা ছিল কি না ইহাই জানিবার জন্য সুচরিতার ঔৎসুক্য ছিল । সে কথা সে স্পষ্ট করিয়া পাড়িতে পারিল না, এবং আনন্দময়ী গােরার নামমাত্রও উচ্চারণ করিলেন না। হরিমোহিনী খবর পাইয়াছিলেন । ধীরে সুস্থে হাতের কােজ সারিয়া তিনি ঘরের মধ্যে আসিলেন এবং কহিলেন, “দিদি, ভালো আছ তো ? দেখাই নেই, খবরই নাও না ।” আনন্দময়ী সেই অভিযোগের উত্তর না করিয়া কহিলেন, “তোমার বোনঝিকে নিতে এসেছি।” এই বলিয়া তাহার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করিয়া বলিলেন । হরিমোহিনী অপ্ৰসন্ন মুখে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন ; পরে কহিলেন, “আমি তো এর মধ্যে যেতে পারব না ।” আনন্দময়ী কহিলেন, “না বোন, তোমাকে আমি যেতে বলি নে । সুচরিতার জন্যে তুমি ভেবো না, আমি তো ওর সঙ্গেই থাকিব ।” হরিমোহিনী কহিলেন, “তবে বলি। রাধারানী তো লোকের কাছে বলছেন উনি হিন্দু। এখন ওঁর মতিগতি হিন্দুয়ানির দিকে ফিরেছে। তা, উনি যদি হিন্দুসমাজে চলতে চান তা হলে ওঁকে সাবধান হতে হবে । অমনিতেই তো ঢের কথা উঠবে তা সে আমি কাটিয়ে দিতে পারব, কিন্তু এখন থেকে কিছুদিন ওঁকে সামলে চলা চাই । লোকে তো প্রথমেই জিজ্ঞাসা করে, এত বয়স হল ওঁর বিয়েথাওয়া হল না। কেন । সে একরকম করে চাপাচুপি দিয়ে রাখা চলে, ভালো পােত্রও যে চেষ্টা করলে জোটে না তা নয়, কিন্তু উনি যদি আবার ওঁর সাবেক চাল ধরেন তা হলে আমি কত দিকে সামলাব বলে । তুমি তো হিন্দুঘরের মেয়ে, তুমি তো সব বোঝ, তুমিই বা এমন কথা বল কোন মুখে ? তোমার নিজের মেয়ে যদি থাকত তাকে কি এই বিয়েতে পাঠাতে পারতে ? তোমাকে তো ভাবতে হত মেয়ের বিয়ে দেবে কেমন করে ।” আনন্দময়ী বিস্মিত হইয়া সুচরিতার মুখের দিকে চাহিলেন ; তাহার মুখ রক্তবর্ণ হইয়া ঝাঁ ঝা করিতে লাগিল। আনন্দময়ী কহিলেন, “আমি কোনো জোর করতে চাই নে। সুচরিতা যদি আপত্তি করেন তবে আমি—” হরিমোহিনী বলিয়া উঠিলেন, “আমি তো তোমাদের ভাব কিছুই বুঝে উঠতে পারি নে। তোমারই তো ছেলে ওঁকে হিন্দুমতে লইয়েছেন, তুমি হঠাৎ আকাশ থেকে পড়লে চলবে কেন ?” পরেশবাবুর বাড়িতে সর্বদাই অপরাধতীরুর মতো যে হরিমোহিনী ছিলেন, যিনি কোনো মানুষকে ঈষৎমাত্র অনুকুল বােধ করিলেই একান্ত আগ্রহের সহিত অবলম্বন করিয়া ধরিতেন, সে হরিমোহিনী কোথায় ? নিজের অধিকার রক্ষা করিবার জন্য ইনি আজ বাঘিনীর মতো দাড়াইয়াছেন ; তাহার সুচরিতাকে তাহার কােছ হইতে ভাঙাইয়া লইবার জন্য চারি দিকে নানা বিরুদ্ধ শক্তি কাজ করিতেছে এই সন্দেহে তিনি সর্বদাই কণ্টকিত হইয়া আছেন। কে স্বপক্ষ কে বিপক্ষ তাহা বুঝিতেই পারিতেছেন না, এইজন্য র্তাহার মনে আজ আর স্বচ্ছন্দতা নাই। পূর্বে সমস্ত সংসারকে শূন্য দেখিয়া যে দেবতাকে