পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা \ጋ9ዓ বাকলচিত্তে আশ্রয় করিয়াছিলেন সেই দেবপূজাতেও তাঁহার চিত্ত স্থির হইতেছে না। একদিন তিনি ঘোরতর সংসারী ছিলেন— নিদারুণ শোকে যখন তাহার বিষয়ে বৈরাগ্য জন্মিয়াছিল তখন তিনি মনেও করিতে পারেন নাই যে আবার কোনােদিন তাহার টাকাকড়ি ঘরবাড়ি আত্মীয়পরিজনের প্রতি কিছুমাত্র আসক্তি ফিরিয়া আসিবে ; কিন্তু আজ হৃদয়ক্ষতের একটু আরোগ্য হইতেই সংসার পুনরায় তাহার অনেক দিনের ক্ষুধা লইয়া পূর্বের মতােই জাগিয়া উঠিতেছে, যাহা ত্যাগ করিয়া আসিয়াছিলেন সেই দিকে পুনর্বার ফিরিবার বেগ এমনি উগ্ৰ হইয়া উঠিয়াছে যে, সংসারে যখন ছিলেন তখনো তাহাকে এত চঞ্চল করিতে পারে নাই । অল্প কয় দিনেই হরিমোহিনীর মুখে চক্ষে, ভাবে ভঙ্গিতে, কথায় ব্যবহারে এই অভাবনীয় পরিবর্তনের লক্ষণ দেখিয়া আনন্দময়ী একেবারে আশ্চর্য হইয়া গেলেন এবং সুচরিতার জন্য তাহার মেহকোমল হৃদয়ে অত্যন্ত ব্যথা বােধ করিতে লাগিলেন। এমন যে একটা সংকট প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে তাহা জানিলে তিনি কখনোই সুচরিতাকে ডাকিতে আসিতেন না। এখন কী মুক্ত কৃতিকে আঘাত ইত কওঁতে পারলে দে ঔয়র পরে এক সঙ্গর বিস্তু ইয় গোরার প্রতি লক্ষ করিয়া যখন হরিমোহিনী কথা কহিলেন তখন সুচরিতা মুখ নত করিয়া নীরবে ঘর হইতে উঠিয়া চলিয়া গেল । আনন্দময়ী কহিলেন, “তোমার ভয় নেই বোন ! আমি তো আগে জানতুম না। তা, আর ওকে পীড়াপীড়ি করব না। তুমিও ওকে আর কিছু বােলো না। ও আগে একরকম করে মানুষ হয়েছে, হঠাৎ ওকে যদি বেশি চাপ দাও সে আবার সইবে না।” হরিমোহিনী কহিলেন, “সে কি আমি বুঝি নে, আমার এত বয়স হল ! তোমার মুখের সামনেই বলুক-না, আমি কি ওকে কোনােদিন কিছু কষ্ট দিয়েছি। ওর যা খুশি তাই তাে করছে, আমি কখনাে একটি কথা কই নে— বলি, ভগবান ওকে বঁচিয়ে রাখুন। সেই আমার ঢের— যে আমার কপাল, কোনদিন কী ঘটে সেই ভয়ে ঘুম হয় না।” আনন্দময়ী যাইবার সময় সুচরিতা তাহার ঘর হইতে বাহির হইয়া তীহাকে প্ৰণাম করিল। আনন্দময়ী সকরুণ স্নেহে তাহাকে স্পর্শ করিয়া কহিলেন, “আমি আসব, মা, তােমাকে সব খবর দিয়ে যাব।— কোনো বিঘ্ন হবে না— ঈশ্বরের আশীর্বাদে শুভকর্ম সম্পন্ন হয়ে যাবে।” সুচরিতা কোনো কথা কহিল না | পরদিন প্রাতে আনন্দময়ী লছমিয়াকে লইয়া যখন সেই বাসাবাড়ির বহুদিনসঞ্চিত ধূলি ক্ষয় করিবার জন্য একেবারে জলপ্লাবন বাধাইয়া দিয়াছেন এমন সময় সুচরিতা আসিয়া উপস্থিত হইল। আনন্দময়ী তাড়াতাড়ি বঁটা ফেলিয়া দিয়া তাহাকে বুকে টানিয়া লইলেন । তার পরে ধোওয়ামোছা জিনিসপত্র-নাড়াচাড়া ও সাজানাের ধুম পড়িয়া গেল। পরেশবাবু খরচের জন্য সুচরিতার হাতে উপযুক্ত পরিমাণ টাকা দিয়াছিলেন ; সেই তহবিল লইয়া উভয়ে মিলিয়া বারবার গৈল ; তিনি মুখ ফিরাইয়া বসিয়া রহিলেন এবং সে চলিয়া গেলে অশ্রুপাত করিতে লাগিলেন। ললিতার বিবাহ-ব্যাপারে লাবণ্য ও লীলার মনে মনে যথেষ্ট ঔৎসুক্য ছিল ; কােনাে উপায়ে যদি আঁহীরা ছুটি পাইত। তবে বিবাহ-আসরে চুটিয়া যাইতে এক মুহূর্ত বিলম্ব করিত না। কিন্তু ললিতা যখন বিদায় হইয়া গেল তখন ব্রহ্মপরিবারের কঠোর কর্তব্য স্মরণ করিয়া তাহারা মুখ অত্যন্ত গভীর করিয়া