পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Vか○br রবীন্দ্র-রচনাবলী রহিল। দরজার কাছে সুধীরের সঙ্গে চকিতের মতাে ললিতার দেখা হইল ; কিন্তু সুধীরের পশ্চাষ্ট্রে তাহাদের সমাজের আরো কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি ছিলেন, এই কারণে তাহার সঙ্গে কোনো কথা হইতেই পারিল না। গাড়িতে উঠিয়া ললিতা দেখিল আসনের এক কোণে কাগজে মােড়া কী একটি রহিয়াছে। খুলিয়া দেখিল, জর্মন-রৌপ্যের একটি ফুলদানি, তাহার গায়ে ইংরাজি ভাষায় খেদা রহিয়াছে, ‘আনন্দিত দম্পতিকে ঈশ্বর আশীৰ্বাদ করুন এবং একটি কার্ডে ইংরাজিতে সুধীরের কেক নামের আদ্যক্ষরটি ছিল। ললিতা আজ হৃদয়কে কঠিন করিয়া পণ করিয়াছিল সে চােখের জন্ম ফেলিবে না, কিন্তু পিতৃগৃহ হইতে বিদায়-মুহুর্তে তাঁহাদের বাল্যবন্ধুর এই একটিমাত্র স্নেহােপহার হাতে লইয়া তাহার দুই চক্ষু দিয়া ঝরঝর করিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। পরেশবাবু চক্ষু মুদ্রিত করিয়া স্থির হইয়া বসিয়া রহিলেন। আনন্দময়ী “এসো এসো, মা এসো” বলিয়া ললিতার দুই হাত ধরিয়া তাহাকে ঘরে লইয় আসিলেন, যেন এখনই তাহার জন্য তিনি প্ৰতীক্ষা করিয়া ছিলেন । পরেশবাবু সুচরিতাকে ডাকাইয়া আনিয়া কহিলেন, “ললিতা আমার ঘর থেকে একেবারে বিদায় নিয়ে এসেছে।” পরেশের কণ্ঠস্বর কম্পিত হইয়া গেল । সুচরিতা পরেশের হাত ধরিয়া কহিল, “এখানে ওর স্নেহযত্নের কোনো অভাব হবে না। বাবা। " পরেশ যখন চলিয়া যাইতে উদ্যত হইয়াছেন এমন সময়ে আনন্দময়ী মাথার উপর কাপড় টানিয়া র্তাহার সম্মুখে আসিয়া তীহাকে নমস্কার করিলেন। পরেশ ব্যস্ত হইয়া তীহাকে প্রতিনমস্কার করিলেন। আনন্দময়ী কহিলেন, “ললিতার জন্যে আপনি কোনো চিন্তা মনে রাখবেন না । আপনি যার হাতে ওকে সমর্পণ করছেন তার দ্বারা ও কখনো কোনো দুঃখ পাবে না- আর ভগবান এতকাল পরে আমার এই একটি অভাব দূর করে দিলেন, আমার মেয়ে ছিল না, আমি মেয়ে পেলুম। বিনয়ের বউটিকে নিয়ে আমার কন্যার দুঃখ ঘুচিবে অনেক দিন ধরে এই আশাপথ চেয়ে বসে ছিলুম ; তা অনেক দেরিতে যেমন ঈশ্বর আমার কামনা পূরণ করে দিলেন, তেমনি এমন মেয়ে দিলেন আর এমন আশ্চর্য রকম করে দিলেন যে, আমি আমার এমন ভাগ্য কখনো মনে চিন্তাও করতে পারতুম না।” ললিতার বিবাহের আন্দোলন আরম্ভ হওয়ার পর হইতে এই প্রথম পরেশবাবুর চিত্ত সংসারের মধ্যে এক জায়গায় একটা কুল দেখিতে পাইল এবং যথার্থ সান্তুনা লাভ করিল। \ტრl কারাগার হইতে বাহির হওয়ার পর হইতে গোরার কাছে সমস্ত দিন এত লোকসমাগম হইতে লাগিল যে তাঁহাদের স্তবস্তুতি ও আলাপ-আলোচনার নিশ্বাসরোধকর অজস্র বাক্যরাশির মধ্যে বাড়িতে বাস করা তাহার পক্ষে অসাধ্য হইয়া উঠিল । গোরা তাই পূর্বের মতো পুনর্বাের পল্লীস্ৰমণ আরম্ভ করিল। সকালবেলায় কিছু খাইয়া বাড়ি হইতে বাহির হইত, একেবারে রাত্রে ফিরিয়া আসিত । ট্রেনে করিয়া কলিকাতার কাছাকাছি কোনো-একটা স্টেশনে নামিয়া পল্লীগ্রামের মধ্যে গিয়া প্ৰবেশ করিত । সেখানে কলু কুমার কৈবর্ত প্রভৃতিদের পাড়ায় সে আতিথ্য লাইত। এই গীেরবর্ণ প্রকাণ্ডকায় ব্রাহ্মণটি কেন যে তাহাদের বাড়িতে এমন করিয়া ঘুরিতেছে, তাহাদের সুখদুঃখের খবর লইতেছে, তাহা তাহারা কিছুই বুঝিতে পারিত না ; এমন-কি, তাহাদের মনে নানাপ্রকার সন্দেহ জন্মিত। কিন্তু গোরা তাঁহাদের সমস্ত সংকোচ-সন্দেহ ঠেলিয়া তাহাদের মধ্যে বিচরণ করিতে লাগিল । মাঝে মাঝে সে অপ্ৰিয় কথাও শুনিয়াছে, তাহাতেও নিরস্ত হয় নাই । যতই ইহাদের ভিতরে প্রবেশ করিল ততই একটা কথা কেবলই তাহার মনের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। সে দেখিল, এই সকল পল্লীতে সমাজের বন্ধন শিক্ষিত ভদ্রসমাজের চেয়ে অনেক বেশি। প্রত্যেক ঘরের খাওয়াদাওয়া শোওয়াবসা কাজকর্ম সমস্তই সমাজের নিমেষহীন চোখের উপর্থে