পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরী VVDS দিনরাত্রি রহিয়াছে। প্রত্যেক লোকেরই লোকাচারের প্রতি অত্যন্ত একটি সহজ বিশ্বাস- সে সম্বন্ধে কিছুমাত্র বল দিতেছে না। ইহাদের মতো এমন ভীত, অসহায়, আত্মহতবিচারে অক্ষম জীব জগতে কোথাও আছে কি না সন্দেহ। আচারকে পালন করিয়া চলা ছাড়া আর কোনাে মঙ্গলকে ইহারা সম্পূর্ণ মুনের সঙ্গে চেনেও না, বুঝাইলেও বুঝে না। দণ্ডের দ্বারা, দলাদলির দ্বারা, নিষেধটাকেই তাহারা সব চেয়ে বড়ো করিয়া বুঝিয়াছে। কী করিতে নাই এই কথাটাই পদে পদে নানা শাসনের দ্বারা তাহাদের প্রকৃতিকে যেন আপাদমস্তক জালে বাধিয়াছে। কিন্তু এ জাল ঋণের জাল, এ বাঁধন মহাজনের বাধন- রাজার বঁাধন নহে। ইহার মধ্যে এমন কোনো বড়ো ঐক্য নাই যাহা সকলকে বিপদে সম্পদে পাশাপাশি দাঁড় করাইতে পারে। গােরা না দেখিয়া থাকিতে পারিল না যে, এই আচারের অন্ত্রে মানুষ মানুষের রক্ত শোষণ করিয়া তাহাকে নিষ্ঠুরভাবে নিঃস্বত্ব করিতেছে। কতবার সে দেখিয়ছে, সমাজে ক্রিয়াকর্মে কেহ কহাকেও দয়ামাত্রও করে না। একজনের বাপ দীর্ঘকাল রোগে ভুগতেছিল, সেই বাপের চিকিৎসা পথ্য প্রভৃতিতে বেচারা সর্বস্বাস্ত হইয়াছে, সে সম্বন্ধে কাহারও নিকট হইতে তাহার কোনো সাহায্য নাই- এ দিকে গ্রামের লোকে ধরিয়া পড়িল তাহার পিতাকে অজ্ঞাতপাতকজনিত চিরক্কগণতার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে। সে হতভাগের দারিদ্র্য অসামর্থ কাহারও অগোচর ছিল না, কিন্তু ক্ষমা নাই। সকলপ্রকার ক্রিয়াকর্মেই এইরূপ । যেমন ডাকাতির অপেক্ষা পুলিস-তদন্ত গ্রামের পক্ষে গুরুতর দুর্ঘটনা, তেমনি মা-বাপের মৃত্যুর অপেক্ষা মা-বাপের শ্ৰাদ্ধ সন্তানের পক্ষে গুরুতর দুর্ভাগের কারণ হইয়া উঠে। অল্প আয় অল্প শক্তির দােহাই কেহই মানিবে না, যেমন করিয়া হউক সামাজিকতার হৃদয়হীন দাবি ষোলো-আনা পূরণ করিতে হইবে । বিবাহ উপলক্ষে কন্যার পিতার বােঝা যাহাতে দুঃসহ হইয়া উঠে এইজন্য বরের পক্ষে সর্বপ্রকার কৌশল অবলম্বন করা হয়, হতভাগ্যের প্রতি লেশমাত্র করুণা নাই | গোরা দেখিল এই সমাজ মানুষকে প্রয়োজনের সময় সাহায্য করে না, বিপদের সময় ভরসা দেয় না, কেবল শাসনের দ্বারা নতি স্বীকার করাইয়া বিপন্ন করে । শিক্ষিতসমাজের মধ্যে গােরা এ কথা ভুলিয়াছিল। কারণ, সে সমাজে সাধারণের মঙ্গলের জন্য । এক হইয়া দাড়াইবার শক্তি বাহির হইতে কাজ করিতেছে। এই সমাজে একত্রে মিলিবার নানাপ্রকার উদযোগ দেখা দিতেছে। এই সকল মিলিত চেষ্টা পাছে পরের অনুকরণ রূপে আমাদিগকে নিস্ফলতার দিকে লইয়া যায়। সেখানে ইহাই কেবল ভাবিবার বিষয় । কিন্তু পল্লীর মধ্যে যেখানে বাহিরের শক্তিসংঘাত তেমন করিয়া কাজ করিতেছে না, সেখানকার নিশ্চেষ্টতার মধ্যে গােরা স্বদেশের গভীরতর দুর্বলতার যে মূর্তি তাহাই একেবারে অনাবৃত দেখিতে পাইল । যে ধর্ম সেবারূপে, প্রেমরূপে, করুণারূপে, আত্মত্যাগরিপে এবং মানুষের প্রতি শ্রদ্ধারূপে সকলকে শক্তি দেয়, প্ৰাণ দেয়, কল্যাণ দেয়, কোথাও তাঁহাকে দেখা যায় না। যে আচার কেবল রেখা টানে, ভাগ করে, পীড়া দেয়, যাহা বুদ্ধিকেও কোথাও আমল দিতে চায় না, যাহা গ্ৰীতিকেও দূরে খেদাইয়া রাখে, তাহাই সকলকে চলিতে-ফিরিতে উঠিতে-বসিতে সকল বিষয়েই কেবল বাধা দিতে থাকে। পল্লীর মধ্যে এই মূঢ় বাধ্যতার অনিষ্টকর কুফল এত স্পষ্ট করিয়া এত নানারকমে গােরার চোখে পড়িতে লাগিল, তাহা মানুষের স্বাস্থ্যকে জ্ঞানকে ধর্মবুদ্ধিকে কর্মকে এত দিকে এতপ্রকারে আক্রমণ করিয়াছে দেখিতে পাইল যে, নিজেকে ভাবুকতার ইন্দ্ৰজালে ভুলইয়া রাখা গোরার পক্ষে অসম্ভব হইয়া উঠিল । গোরা প্রথমেই দেখিল, গ্রামের নীচজাতির মধ্যে স্ত্রীসংখ্যার অল্পতা-বশত অথবা অন্য যে-কারণ-বশত হউক অনেক পণ দিয়া তবে বিবাহের জন্য মেয়ে পাওয়া যায়। অনেক পুরুষকে চিরজীবন এবং অনেককে অধিক বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত থাকিতে হয়। এ দিকে বিধবার বিবাহ সম্বন্ধে কঠিন নিষেধ। ইহাতে ঘরে ঘরে সমাজের স্বাস্থ্য দূষিত হইয়া উঠিতেছে এবং ইহার অনিষ্ট ও অসুবিধা সমাজের প্রত্যেক লোকই অনুভব করিতেছে। এই অকল্যাণ চিরদিন বহন করিয়া চলিতে সকলেই বাধ্য, কিন্তু ইহার প্রতিকার করিবার উপায় কোথাও কাহারও হাতে নাই। শিক্ষিতসমাজে যে গোরা