পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ტ8 O রবীন্দ্র-রচনাবলী আচারকে কোথাও শিথিল হইতে দিতে চায় না। সেই গোরা এখানে আচারকে আঘাত করিল। সে ইহাদের পুরোহিতদিগকে বশ করিল, কিন্তু সমাজের লোকদের সম্মতি কোনোমতেই পাইল না। তাহারা গোরার প্রতি ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল ; কহিল, “বেশ তো, ব্ৰাহ্মণেরা যখন বিধবাবিবাহ দিবেন। আমরাও তখন দিব ।” তাহাদের রাগ হইবার প্রধান কারণ এই যে, তাহারা মনে করিল গোরা তাহাদিগকে হীনজাতি বলিয়া অবজ্ঞা করিতেছে, তাহাদের মতো লোকের পক্ষে নিতান্ত হীন আচার অবলম্বন করাই যে শ্ৰেয় ইহাই গোরা প্রচার করিতে আসিয়াছে। পল্লীর মধ্যে বিচরণ করিয়া গোরা ইহাও দেখিয়ছে, মুসলমানদের মধ্যে সেই জিনিসটি আছে যাহা অবলম্বন করিয়া তাহাদিগকে এক করিয়া দাড় করানো যায়। গোরা লক্ষ্য করিয়া দেখিয়াছে গ্রামে কোনো আপদ বিপদ হইলে মুসলমানেরা যেমন নিবিড়ভাবে পরস্পরের পার্থে আসিয়া সমবেত হয় হিন্দুরা এমন হয় না। গোরা বার বার চিন্তা করিয়া দেখিয়াছে এই দুই নিকটতম প্রতিবেশী সমাজের মধ্যে এতবড়ো প্ৰভেদ কেন হইল। যে উত্তরটি তাহার মনে উদিত হয়। সে উত্তরটি কিছুতেই তাহার মানিতে ইচ্ছা হয় না। এ কথা স্বীকার করিতে তাহার সমস্ত হৃদয় ব্যথিত হইয়া উঠিতে লাগিল যে, ধর্মের দ্বারা মুসলমান এক, কেবল আচারের দ্বারা নহে। এক দিকে যেমন আচারের বন্ধন তাহাদের সমস্ত কর্মকে অনর্থক বাধিয়া রাখে নাই, অন্য দিকে তেমনি ধর্মের বন্ধন তাহাদের মধ্যে একান্ত ঘনিষ্ঠ | তাহারা সকলে মিলিয়া এমন একটি জিনিসকে গ্রহণ করিয়াছে যাহা না-মাত্র নহে, যাহা ‘ই’ ; যাহা ঋণাত্মক নহে, যাহা ধনাত্মক ; যাহার জন্য মানুষ এক আহ্বানে এক মুহুর্তে একসঙ্গে দাড়াইয়া অনায়াসে প্ৰাণবিসর্জন করিতে পারে । শিক্ষিতসমাজে গোরা যখন লিখিয়াছে, তর্ক করিয়াছে, বক্তৃতা দিয়াছে, তখন সে অন্যকে বুঝাইবার জন্য, অন্যকে নিজের পথে আনিবার জন্য, স্বভাবতই নিজের কথাগুলিকে কল্পনার দ্বারা মনােহর বর্ণে রঞ্জিত করিয়াছে; যাহা স্কুল তাঁহাকে সূক্ষ্ম ব্যাখ্যার দ্বারা আবৃত করিয়াছে, যাহা অনাবশ্যক ভগ্নাবশেষমাত্র তাহাকেও ভাবের চন্দ্রালোকে মোহময় ছবির মতো করিয়া দেখাইয়াছে। দেশের এক দল লোক দেশের প্রতি বিমুখ বলিয়াই, দেশের সমস্তই তাহারা মন্দ দেখে বলিয়াই, স্বদেশের প্রতি প্রবল অনুরাগ-বশত গোরা এই মমত্বহীন দৃষ্টিপাতের অপমান হইতে বাচাইবার জন্য স্বদেশের সমস্তকেই অত্যুজ্বল ভাবের আবরণে ঢাকিয়া রাখিতে অহােরাত্র চেষ্টা করিয়াছে। ইহাই গোরার অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিল । সবই ভালো, যাহাকে দোষ বলিতেছ। তাহা কোনো-এক ভাবে গুণ, ইহা যে গোরা কেবল উকিলের মতো প্ৰমাণ করিত তাহা নহে, ইহাই সে সমস্ত মন দিয়া বিশ্বাস করিত | নিতান্ত অসম্ভব স্থানেও এই বিশ্বাসকে স্পর্ধার সহিত জয়পতাকার মতো দৃঢ় মুষ্টিতে সমস্ত পরিহাসপরায়ণ শত্রুপক্ষের সম্মুখে সে এক খাড়া করিয়া দাড়াইয়াছে। তাহার কেবল একটিমাত্ৰ কথা ছিল, স্বদেশের প্রতি স্বদেশবাসীর শ্রদ্ধা সে ফিরাইয়া আনিবে, তাহার পরে অন্য কাজ । কিন্তু যখন সে পল্লীর মধ্যে প্রবেশ করে তখন তো তাহার সম্মুখে কোনাে শ্রোতা থাকে না, তখন তো তাহার প্রমাণ করিবার কিছুই নাই, অবজ্ঞা ও বিদ্বেষকে নত করিয়া দিবার জন্য তাহার সমস্ত বিরুদ্ধ শক্তিকে জাগ্ৰত করিয়া তুলিবার কোনো প্রয়োজন থাকে না- এইজন্য সেখানে সত্যকে সে কোনােপ্রকার আবরণের ভিতর দিয়া দেখে না। দেশের প্রতি তাহার অনুরাগের প্রবলতাই তাহার সত্যদৃষ্টিকে অসামান্যরূপে তীক্ষা করিয়া দেয়। \ტხr গায়ে তসরের চায়না কোট, কোমরে একটা চাদর জড়ানো, হাতে একটা ক্যাম্বিসের ব্যােগ— স্বয়ং কৈলাস আসিয়া হরিমোহিনীকে প্ৰণাম করিল। তাহার বয়স পঁয়ত্ৰিশের কাছাকাছি হইবে, বেঁটেখাটাে আঁটর্সটি মজবুত গোছের চেহারা, কামানো গোফদাড়ি কিছুদিন ক্ষৌরকর্মের অভাবে কুশগ্রের ন্যায়