পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা - V8S অনেক দিন পরে শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়কে দেখিয়া আনন্দিত হইয়া হরিমোহিনী বলিয়া উঠিলেন, “একি, ঠাকুরপো যে ! বোসো, বোসো ।” বলিয়া তাড়াতাড়ি একখানি মাদুর পাতিয়া দিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “হাত-পা ধােবে ?” কৈলাস কহিল, “না, দরকার নেই। তা, শরীর তো বেশ ভালোই দেখা যাচ্ছে।” শরীর ভালো থাকাটাকে একটা অপবাদ জ্ঞান করিয়া হরিমোহিনী কহিলেন, “ভালো আর কই আছে!” বলিয়া নানাপ্রকার ব্যাধির তালিকা দিলেন, ও কহিলেন, “তা, পোড়া শরীর গেলেই যে বঁচি, মরণ তো হয় না ।” জীবনের প্রতি এইরূপ উপেক্ষায় কৈলাস আপত্তি প্ৰকাশ করিল এবং যদিচ দাদা নাই। তথাপি হরিমোহিনী থাকতে তাহাদের যে একটা মস্ত ভরসা আছে তাহারই প্রমাণস্বরূপে কহিল, “এই দেখে-না কেন, তুমি আছ বলেই কলকাতায় আসা হল- তবু একটা দাড়াবার জায়গা পাওয়া গেল।” আত্মীয়স্বজনের ও গ্রামবাসীদের সমস্ত সংবাদ আদ্যোপােন্ত বিবৃত করিয়া কৈলাস হঠাৎ চারিদিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “এ বাড়িটা বুঝি তারই ?” r হরিমোহিনী কহিলেন, “হঁ৷ ” কৈলাস কহিল, “পাকা বাড়ি দেখছি!” হরিমোহিনী তাহার উৎসাহকে উদ্দীপিত করিয়া কহিলেন, “পাকা বৈকি ! সমস্তই পাকা ।” ঘরের কড়িগুলা বেশ মজবুত শালের, এবং দরজা-জানলাগুলো আমাকাঠের নয়, ইহাও সে লক্ষ্য করিয়া দেখিল। বাড়ির দেয়াল দেড়খানা ইটের গাথনি কি দুইখন ইটের তাহাও তাহার দৃষ্টি এড়াইল না । উপরে নীচে সর্বসমেত কয়টি ঘর তাহাও সে প্রশ্ন করিয়া জানিয়া লইল । মোটের উপর জিনিসটা তাহার কাছে বেশ সন্তোষজনক বলিয়াই বোধ হইল। বাডি তৈরি করিতে কত খরচ পডিয়াছে তাহা আন্দাজ করা তাহার পক্ষে শক্ত, কারণ, এ-সকল মালমসলার দর তাহার ঠিক জানা ছিল না— চিন্তা করিয়া, পায়ের উপর পা নাড়িতে নাড়িতে মনে মনে কহিল ‘কিছু না হােক দশ-পনেরো হাজার টাকা তো হবেই। মুখে একটু কম করিয়া বলিল, “কী বল বউঠাকরুন, সাত-আট হাজার টাকা হতে পারে ।” হরিমোহিনী কৈলাসের গ্রাম্যতায় বিস্ময় প্রকাশ করিয়া কহিলেন, “বল কী ঠাকুরপো, সাত-আট হাজার টাকা কী ! বিশ হাজার টাকার এক পয়সা কম হবে না।” কৈলাস অত্যন্ত মনোযোগের সহিত চারি দিকের জিনিসপত্র নীরবে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল । এখনই সম্মতিসূচক একটা মাথা নাড়িলেই এই শালকাঠের কড়িবারগা ও সেগুনকাঠের জানলা-দরজা-সমেত পাকা ইমারতটির একেশ্বর প্রভু। সে হইতে পারে এই কথা চিন্তা করিয়া সে খুব একটা পরিতৃপ্তি বােধ করিল। জিজ্ঞাসা করিল, “সব তো হল, কিন্তু মেয়েটি ?” হরিমোহিনী তাড়াতাড়ি কহিলেন, “তাঁর পিসির বাড়িতে হঠাৎ তার নিমন্ত্রণ হয়েছে, তাই গেছেদু-চার দিন দেরি হতে পারে।” কৈলাস কহিল, “তা হলে দেখার কী হবে ? আমার যে আবার একটা মকদ্দমা আছে, কালই যেতে হবে ।” হরিমোহিনী কহিলেন, “মকদ্দমা তোমার এখন থাক । এখানকার কােজ সারা না হলে তুমি যেতে পারিছ না ।” কৈলাস কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া শেষকালে স্থির করিল, নাহয় মকদ্দমাটা একতরফা ডিগ্রি হয়ে ফেসে যাবে। তা যাক গে। এখানে যে তাহার ক্ষতিপূরণের আয়োজন আছে তাহা আর-একবার চারি দিক নিরীক্ষণ করিয়া বিচার করিয়া লইল । হঠাৎ চােখে পড়িল, হরিমোহিনীর পূজার ঘরের কোণে কিছু জল জমিয়া আছে। এ ঘরে জল-নিকাশের কোনো প্ৰণালী ছিল না ; অথচ হরিমোহিনী সর্বদাই জল দিয়া এ ঘর ধোওয়ামোছা করেন ; সেইজন্য কিছু জল একটা কোণে বধিয়াই থাকে। কৈলাস ব্যস্ত হইয়া কহিল, “বউঠাকরুন, ওটা তো ভালো হচ্ছে না ।”